মিষ্টি পরিবারের আজ এমন এক সদস্যের কথা বলব যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও আজ খানিক লুপ্তপ্রায় বলা চলে। যদিও স্বাদে সে কিন্তু এক্কেবারে বাকিদের টেক্কা দিতে পারে। সে তথ্যই দেব আজ।
বলছি গঙ্গাজলি বা পদ্মচিনির কথা। গঙ্গাজলি হল ঘন চিনির রসে পাক করা নারকেল বাটা দিয়ে তৈরী একপ্রকার মিহি সাদা গুঁড়ো মিষ্টি। এর আরেক নাম পদ্মচিনি। যদিও পরে নাড়ু ও সন্দেশের আকারও দেওয়া হতো। তাই গঙ্গাজলি নাড়ু ও সন্দেশ নামেও এর পরিচিতি ঘটে পরবর্তীকালে, বানানোর প্রসঙ্গে আসছি পরে। আগে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব জানা প্রয়োজন।
এই গঙ্গাজলির উল্লেখ পাওয়া যায় শ্রী শ্রী কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী রচিত চৈতন্যচরিতামৃত এবং রূপরাম চক্রবর্তী রচিত ধর্মমঙ্গল গ্রন্থেও। কথিত আছে রথযাত্রার সময় মহাপ্রভু যেতেন শ্রীক্ষেত্রে। যাওয়ার আগে পানিহাটিতে ভাগবতাচার্য্য রাঘব পন্ডিতের বাড়িতে সেবা গ্রহণ করতেন। রাঘব পন্ডিতের বাল্যবিধবা ভগিনী দময়ন্তী মহাপ্রভুর যাত্রাপথের যে রসদ প্রস্তুত করতেন তার মধ্যেই অন্যতম হল গঙ্গাজলি নাড়ু। আজও পানিহাটিতে চিঁড়া দধি দণ্ড মহোৎসবের দিনে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভক্তরা মহাপ্রভুর জন্য "রাঘবের ঝালি" প্রস্তুত করেন যাতে থাকে এই গঙ্গাজলি।
গঙ্গাজল বলুন বা গঙ্গাজলি, এই হারিয়ে যাওয়া মিষ্টি বানাতে উপকরণ লাগে যৎসামান্য। মূল উপাদান হল: নারকেল বাটা – ১কাপ, চিনি – ১কাপ, জল – ১/২কাপ, ছোট এলাচ – ৪টে কর্পূর – এক চিমটি আর লাগবে এক গামলা ধৈর্য্য; পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ: নারকেল প্রথমে জলে বেশ কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখতে হবে যাতে কোড়ানোর সময় নারকেল মালার খয়েরী রঙের গোঁফ ধবধবে সাদা নারকেল কোড়ার সঙ্গে না মিশে যায়। এরপর নারকেলের সাদা অংশটা ছাড়িয়ে বেটে নিতে হবে।
এবার এক্কেবারে ধীমে আঁচে চিনি ও জল দিয়ে তাতে আধ থেঁতো এলাচ দিতে হবে। এবার চিনির রস গাঢ় হলে এলাচগুলো তুলে তাতে ধীরে ধীরে নারকেল বাটা দিয়ে নেড়ে নারকেলের সঙ্গে রস একেবারে মিশিয়ে দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন রস ক্যারামেলাইস না হয়ে যায় বা নারকেল লাল না হয়। এবার এক চিমটে কর্পূর মিশিয়ে একটা বড় থালায় ঢেলে ঠান্ডা করতে হবে। আগুনের কম তাপে নারকেলের ধবধবে সাদা রং গঙ্গাজলের রূপ নেয়। সেই থেকেই এর এই নাম।
এরপর শিলে বা মিক্সিতে বেটে গুঁড়ো পাউডারের মতো হলেই তৈরী গঙ্গাজলি। প্রাথমিকভাবে এইভাবে থাকলেও পরবর্তীকালে সন্দেশের আকার দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে একটা সুতির কাপড় একটা ছাঁচের মধ্যে দিয়ে তার ওপর গঙ্গাজলি খুব চেপে চেপে ভরতে হবে যাতে বাটির আকার ধারণ করে। এবার সাবধানে কাপড় টানলেই গঙ্গাজল মিষ্টি ছাঁচের আকার নেবে।
এককালে কৃষ্ণনগরের গঙ্গাজলি সন্দেশের খ্যাতি ছিল। সময়ের অভাবে যার অস্তিত্ব দোকানে তেমন না থাকলেও এখনো হেঁশেল খুঁজলে মিলবে বৈকি! তবে আজ এর দেখা মেলে কৃষ্ণনগর, মায়াপুরে। প্রণালী তো জানা গেল শুধু সময় করে বানিয়ে ফেললেই হল। মনে হয় মন্দ লাগবে না।