"আলি আকবর ভাইয়ের মধ্যে একটা আশ্চর্য কল্পনার ব্যাপার ছিল যেটা আমি প্রথম দিকে চিনতে পারিনি বা বুঝতে পারিনি। ওটা ক্রমে এমন সুন্দরভাবে প্রকাশ পেল, তা সে বাবার তালিম এবং ওর একটা অসামান্য সংগীত চেতনা সব মিলিয়েই। ও এত অদ্ভুত, নিজস্ব সুরের কল্পনা এবং বিস্তার থেকে থেকে করতে পারে যে, সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতাকে তাই দিয়ে বিলকুল মাত করে দেয়। ওর বাজনায় ঐ যে মাখোমাখো ভাব তার মধ্যে প্রচন্ড ভালবাসা লুকিয়ে থাকে"। প্রখ্যাত সরোদিয়া আলি আকবর খাঁ- এর বাজনাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন পন্ডিত রবিশঙ্কর। প্রায় একই বয়সী, একই সঙ্গে একই গুরুর কাছে শিক্ষা নেওয়া দুই দিকপালের একজন যখন অপর জন সম্পর্কে কোনও উক্তি করেন তখন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে, ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে শিবপুর গ্রামে আলি আকবর খাঁ সাহেবের জন্ম। তাঁর পিতা সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ এবং মা মদিনা বেগম।
জন্ম বাংলাদেশে হলেও আলি আকবর খাঁ বড় হয়ে উঠেছেন এই দেশে। তাঁর বাবা উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব ছিলেন বর্তমান মধ্যপ্রদেশের মাইহার রাজ্যের সভাশিল্পী। মাত্র ছ মাস বয়েসে আলি আকবরকে মাইহারে নিয়ে আসা হয়। তাঁর যখন তিন বছর বয়েস তখন আলাউদ্দিন খাঁ তাঁকে কন্ঠসঙ্গীতে তালিম দিতে শুরু করেন। নিতান্ত অল্পবয়সে তাঁর হাতে সরোদ তুলে দিয়েছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ। এক সাক্ষাৎকারে আলি আকবর খাঁ জানিয়েছিলেন, তাঁর যখন ৬/৭ বছর বয়েস তখন একদিন নামাজের পর আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব তাঁকে নিজের ঘরে ডেকে একটি ছোট্ট সরোদ তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই শুরু। এরপর আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের দ্বিতীয়া কন্যার বিবাহ উপলক্ষে তাঁরা সবাই মিলে শিবপুরে ফিরে গিয়েছিলেন। সেখানে বছর দু- তিনেক থাকার সময় আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের বড় ভাই ফকির আফতাবউদ্দিনের কাছে আলি আকবর তালবাদ্য অর্থাৎ তবলা ও পাখোয়াজে তালিম নিয়েছিলেন। এর সঙ্গে আলাউদ্দিন খাঁ–র কাছে চলত সরোদের তালিম। যেতে হত পাঠশালাতেও। ১৯৩৩ সালে আলি আকবর খাঁ– র কাকা উস্তাদ আয়াত আলি খাঁ নিজের হাতে তৈরি একটি সরোদ তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন। এভাবেই একাধিক যন্ত্রে তালিম থাকলেও সরোদ হয়ে উঠেছিল তাঁর নিজস্ব পরিচয়। মাইহারে আলি আকবরের কোনো বিশ্রাম বলে কিছু ছিল না। আলাউদ্দিন খাঁ তাঁর ছেলেকে কারো সঙ্গে মিশতেই দিতেন না। কেবল তালিম আর তালিম। রেওয়াজ আর রেওয়াজ। রেওয়াজ ঠিকমতো না হলেই চলত মার। তবু আলি আকবরের কৈশোরে খেলার প্রতি ঝোঁক ছিল বেশি। বাবা আলাউদ্দীন খাঁ– কে ভয়ঙ্কর ভয় পেতেন। উদয়শঙ্করের ট্রুপের সঙ্গে যখন আলাউদ্দিন খাঁ ইউরোপ গেলেন তখন আলি আকবরেরও যাবার কথা ছিল কিন্তু ভয়ের চোটে এবং মায়ের জন্য মন খারাপ হওয়ায় তিনি যেতে চাইলেন না। এদিকে বাবাকে সেকথা জানাবার সাহস নেই। রবিশঙ্করের মামা তাঁদের সঙ্গে ছিলেন, তাঁকে দিয়ে আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে আবেদন পৌঁছানো হল। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। এরপর দীর্ঘ সময় তাঁর বাবার অনুপস্থিতিতে কিশোর আলি আকবর রেওয়াজ না করে খেলাধূলা, রেকর্ড বাজানো ইত্যাদি করতেন।খবর পৌঁছাল আলাউদ্দিন খাঁর কাছে। তিনি ফিরে এসে দুর্বাসা মূর্তি ধারণ করলেন। শুরু হল ভয়ঙ্কর তালিম। দিনে আঠারো ঘন্টা রেওয়াজ। এমনকি একদিন গাছে বেঁধে রেখে, খেতে না দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর মার। এত কিছু সত্ত্বেও আলি আকবরের প্রথম দিকে শেখার ইচ্ছে খুব তীব্র ছিল না বলে জানিয়েছেন তাঁর সতীর্থ পন্ডিত রবিশঙ্কর। " তখন আমি দেখতাম আমাদের পাগল হয়ে শেখবার শখ ছিল কিন্তু ওর কোনও শখ ছিল না। ওর শুধু খেলাধূলা- এইসব। হয়তো বাবা বাজার থেকে ফিরছেন, দেখাতে হবে খুব রেওয়াজ করেছি, অমনি গেলাসের জল নিয়ে গায়ে- মাথায় ঢেলে ঢুলে একাকার। দেখাতে হবে কত না ঘেমেছি। একেবারে দ্রুত ঝালায় রেওয়াজ করছে"। এই ছেলেমানুষিকে কড়া হাতে দমন করেছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব। চার ঘন্টার বেশি ঘুমোতে না দিয়ে সারাক্ষণ আলি আকবরকে শেখাতে ও রেওয়াজ করাতে শুরু করলেন। ছোটবেলার শক্ত বনিয়াদ তো ছিলই। তার ফলে আলি আকবর খাঁ-র সঙ্গে রবিশঙ্করের মুম্বইতে প্রথম সাক্ষাতের প্রায় বছর দুয়েক পর তিনি যখন মাইহারে এলেন তখন আলি আকবরের বাজনা শুনে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। "এই অল্প সময়ের মধ্যে কি তফাত। বাঘের মতো তৈরি বাজাচ্ছে ও তখন। তাঁর ওপর ভগবানদত্ত ওর ওই সু্রেলা হাত"।
মাইহারে রবিশঙ্কর, আলি আকবর আর অন্নপূর্ণাকে অনেক সময়েই আলাউদ্দিন খাঁ একসঙ্গে তালিম দিতেন। কখনও কখনও আলি আকবর আর রবিশঙ্কর একসঙ্গে বাজাতেন। এভাবেই তাঁদের অসামান্য যুগলবন্দীর সূচনা হয়েছিল বলে রবিশঙ্কর মনে করতেন।" ঐ যে একসঙ্গে বসে বাজানো তাতে প্রথম প্রথম আমাকে একটু অন্যভাবে সেতার মেলাতে হত। পরে রেওয়াজ করে করে আমরা প্রায় একই সুরে নিয়ে আসতে পারলাম। আমাকে নামাতে হল খানিকটা সুর, ওকে চড়াতে হল। অনেক দিন পরে আমাদের যুগলবন্দী যে একটা নতুন যুগের সৃষ্টি করল তার শুরু ও আমাদের একসঙ্গে বসে শিক্ষা নেবার মধ্যে"।
১৯৩৭ সালে মাত্র তেরো বছর বয়সে আলি আকবর প্রথম প্রকাশ্য অধিবেশনে বাজালেন। এর বছর দুয়েক পরে আলি আকবর খাঁ আর পন্ডিত রবিশঙ্কর প্রথম যুগলবন্দী বাজিয়েছিলেন এলাহাবাদে ১৯৩৯ সালে। বাজিয়েছিলেন সকালের রাগ তোড়ী। এর আগে সেতার – সরোদ কখনও একসঙ্গে বাজেনি। পরে অল ইন্ডিয়ার মঞ্চে আলি আকবর- রবিশঙ্কর – নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়- শ্যাম গঙ্গোপাধ্যায় – অনোখেলাল – কেরামতউল্লা খানের একত্র বাদন ও অবশ্য স্মরণীয়। এই শহরেই বেজেছে আলি আকবর আর বিলায়েত খাঁনের অবিস্মরণীয় যুগলবন্দী। আলি আকবর খাঁ- র বাজনার "profoundity" এবং "sense of limit"-এর কথা বারবার বলেছেন রবিশঙ্কর। বলেছেন, "কখনও বোরিং হয়ে যাচ্ছে কিছু একটা, এরকম কোনও দিনও করেনি। ঠিক একই রকম, একই জিনিসই যে বাজায় তা নয়, তবে যতই বিচিত্র ঢঙে বাজাক না কেন, যত অভিনব কাজ করুক না কেন এই sense of proportion এর গুরুত্বটা ওর সর্বক্ষণ হাজির থাকে"।
ছোট থেকে অন্য কারোর বাজনা শোনার সুযোগ হয়নি আলি আকবরের। লক্ষ্ণৌতে রেডিয়োয় কাজ করতে গিয়ে বহু গুণীজনের বাজনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল। কন্ঠসঙ্গীতেও তাঁর জোরদার তালিম ছিল। তালিম ছিল অন্যান্য বহু ধরণের যন্ত্রের সঙ্গেও। সেই সুগভীর তালিম তাঁর বাজনার পরিধি ও tonality কে বিশাল ব্যাপ্তি ও এক গভীর গম্ভীর রূপ দিয়েছিল। যে কারণে তিনি উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ এবং ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের কন্ঠসঙ্গীতের সঙ্গেও যুগলবন্দী করেছিলেন। তিনি নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিলায়েত খাঁ ও এল সুব্রামানিয়াম (বেহালা)- র সঙ্গে ও তিনি বাজিয়েছিলেন। প্রখ্যাত গিটার বাদক জুলিয়েন ব্রিমের সঙ্গেও তিনি অনুষ্ঠান করেছেন। ব্রিম তাঁকে, তাঁর দেখা ‘সবচেয়ে নিখুঁত সঙ্গীতশিল্পী’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
এলাহাবাদে প্রথম সর্বসমক্ষে অনুষ্ঠানের পর আলি আকবর খাঁ দেশের নানান সঙ্গীত সম্মেলনে বাজাতে শুরু করেন। ১৯৩৮ সালে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে অল ইন্ডিয়া রেডিও লক্ষ্ণৌতে যোগ দেন। ১৯৪০ সাল থেকে তিনি লক্ষ্ণৌ রেডিয়োতে প্রতি মাসে একটি করে গানের অনুষ্ঠানও করতেন। এর কিছু বছর পরে তিনি চলে যান দেশীয় রাজ্য যোধপুরে, সেখানকার সভাশিল্পী হয়ে। যোধপুররাজ ছিলেন সঙ্গীতপিপাসু। আলাউদ্দিন খাঁ- কে তিনি অত্যন্ত সম্মান করতেন। যোধপুররাজের জন্য আলি আকবর খাঁ দিনে প্রায় ৮-৯ ঘন্টা বাজাতেন। পরে অবশ্য টেপরেকর্ডার এনে তিনি তাঁর গুরুকে কিছুটা বিশ্রাম দিয়েছিলেন। যোধপুরেই তিনি ‘উস্তাদ’ উপাধি পেয়েছিলেন। যদিও আলি আকবরের এসব পছন্দ ছিল না। ১৯৪৮ সালে এক দুর্ঘটনায় মহারাজ হনবন্ত সিং-এর মৃত্যুতে তিনি যোধপুর ত্যাগ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি এইচ এম ভি থেকে ৭৮ আর পি এম- এর রেকর্ডে মাত্র তিন মিনিটের একটি সরোদবাদন রেকর্ড করেছিলেন। যার নাম তিনি দিয়েছিলেন চন্দ্রনন্দন। রাগটি তিনি মালকোষ, চন্দ্রকোষ, নন্দকোষ এবং কৌশী কানাড়ার সংমিশ্রণে তৈরি করেছিলেন। রাগটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ায় পরে তিনি একে ২২ মিনিটের একটি দীর্ঘ রূপ দিয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে তার রেকর্ডও হয়েছিল।
আলি আকবরের জীবনের আর এক অধ্যায়ের সূচনা হল মুম্বইতে। চেতন আনন্দ পরিচালিত ‘আঁধিয়া’ ছবিতে তিনি সুরকার হিসেবে কাজ করলেন। ছবিতে তাঁর সুরে গান গাইলেন লতা মঙ্গেশকর। কাজ করলেন সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’, তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ইত্যাদি ছবিতে। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’- এর সুর তাঁকে এনে দিল জাতীয় পুরস্কার। মার্চেন্ট আইভরির ‘দ্য হাউসহোল্ডার’ ছবিতেও তিনি সুর দিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে ‘সীমা’ চলচ্চিত্রে তিনি সরোদ বাজালেন। এর পরে দীর্ঘ দিন তাঁর চলচ্চিত্রের সঙ্গে কোনো যোগ ছিল না। ১৯৯৩ সালে প্রখ্যাত পরিচালক বার্তোলুচ্চির ‘লিটল বুদ্ধা’ ছবির জন্য ও তিনি সঙ্গীত নির্মাণ করেছিলেন।
১৯৫৫ সালে ইহুদি মেনুইনের আহ্বানে আমেরিকায় গেলেন আলি আকবর। নিউ ইয়র্কের মিউজিয়ম অফ মডার্ন আর্টে তাঁর সরোদের সুর মোহিত করল দর্শক- শ্রোতাদের। মার্কিন টেলিভিশনেও বাজল তাঁর সরোদ। আলি আকবরের হাত ধরেই মাইহার ঘরানার, তানসেনের বিখ্যাত ঘরানার সুর পৌঁছে গেল সাগরপাড়ে। সেনী ঘরানার নাম ছড়িয়ে পড়ল দেশ-সীমার বাইরে। আলি আকবরের বাজনায় আপ্লুত ইহুদি মেনুইন তাঁকে " the greatest instrumentalist of the 20th century" বলতেও দ্বিধা করেননি।
কী ছিল আলি আকবরের বাজনায়? কিসের জোরে তিনি বিশ্বজয় করেছিলেন? সরোদ এমন এক তারযন্ত্র যেখানে কোনও ঘাট থাকে না। হাতের টিপ দিয়ে তা বাজাতে হয়। আলি আকবরের টিপ ছিল আশ্চর্য মধুর। জুড়ি তার আর চিকারিতেও ঝরে পড়তে লাবণ্য। মীড়ের টান ছিল অনবদ্য। সুরের এমন এক গভীরতায় তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন যে তাঁর সরোদেও সেই মগ্নতা ধরা পড়ত। যে কারণে পন্ডিত রবিশঙ্কর বলেছিলেন, “ওর মধ্যে একটা অতি উচ্চ স্তরের জিনিয়াস, একটা অতুলনীয় শক্তি আছে। বাবার তালিম তো আছেই তার ওপরে ওর যে একটা individual imagination- দারুণ ব্যাপার ভাই।” আলি আকবর জন্মেই ছিলেন রক্তের ভেতর সংগীত নিয়ে। তাঁর মেজাজটাই ছিল আলাদা। বড় শিল্পী, গুণী শিল্পীদের চলনই আলাদা।তিনি বিশ্বাস করতেন প্রতিটি রাগের নিজস্ব শক্তি(Power) আছে। তাদের সেন্টিমেন্ট এবং মুড প্রতিদিন সমানভাবে একজন শিল্পীর কাছে ধরা দেয় না। সাধনার জোর থাকলে অনেকটা ধরা পড়লেও, প্রতিদিন তাদের রূপের প্রকাশ সমানভাবে হয় না।
১৯৫৬ সালে কলকাতায় আলি আকবর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘আলি আকবর কলেজ অফ মিউজিক’। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিস্তার ঘটানো এবং তরুণদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহী করে তোলা। ১৯৬৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে তিনি একটি শাখা শুরু করেন যা পরে সান রাফায়েলে স্থানান্তরিত করা হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিলেন পন্ডিত রবিশঙ্কর। এ কাজে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ, এরিক ক্ল্যাপটন প্রমুখ শিল্পীরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। জন্মভূমিকে মুক্ত করতে উৎসুক আলি আকবর খাঁ ‘বাংলাদেশ ধুন’ নামে একটি নতুন কম্পোজিশন করলেন। যুগলবন্দী বাজালেন পন্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে। ১৯৭১–র অগাস্ট মাসের প্রথম দিনে ম্যাডিসন স্কোয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ বিপুল জনপ্রিয়তা পেল। এই অনুষ্ঠানের রেকর্ডের বিক্রিও হল সর্বোচ্চ। অনুষ্ঠান থেকে পাওয়া অর্থ দান করা হল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। তাঁর অসামান্য সৃজনশীলতা তাঁকে পাঁচবার গ্র্যামি পুরষ্কারের নমিনেশন এনে দিলেও তিনি নানা কারণে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
সঙ্গীতের জগতের অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী ছিলেন আলি আকবর। রাজদরবারে সঙ্গীত পরিবেশন থেকে রেডিও, টেলিভিশন, রেকর্ড,ক্যাসেট, সিডি-র বিস্তৃত জগতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন বাজনা দু’প্রকারের। এক ধরণের বাজনা হল ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ আর অন্যটি হল ‘ঈশ্বরের কাছে নিবেদন’। এর মধ্যে ফারাক তো থাকবেই। নিজের সম্পর্কে দ্বিধাহীনভাবে বলেছিলেন যে তাঁর আক্ষেপ করারও কিছু নেই আবার সার্থক বলারও নেই। বলতেন, ‘যন্ত্র আমি বাজাই না। তখন আমি নোট থেকে শুরু করি যেন ধ্যান থেকে শুরু করি। ‘সা’ দিয়ে শুরু। তার তিন চার সেকেন্ড পরে আমি বাজাই না। আমি আর কিছু মনেও করি না।’ এক ধ্যানমগ্ন শিল্পীর সুরের রেশ ধরে শ্রোতা আর ঈশ্বরের মধ্যে তখন তৈরি হতে থাকে এক আশ্চর্য সেতু। তাঁর বাজনা যেন আকাশ ছুঁয়ে থাকত। বিরজু মহারাজ তাই বলেছিলেন, “ স্বর মে আলি, লয় মে আকবর- আলি আকবর”।
আলি আকবরের পুত্রদের মধ্যে আশিস খাঁ ও ধ্যানেশ খাঁ খ্যাতনামা সরোদশিল্পী। তৃতীয় প্রজন্মে সিরাজ আলি খাঁ-ও সরোদে সুর তোলেন। আলি আকবর বলতেন, যদি কোনও শিল্পী দশ বছর রেওয়াজ করে তবে সে নিজেকে তৃপ্ত করতে পারবে, যদি কুড়ি বছর রেওয়াজ করে তাহলে নিজেকে এবং দর্শক – শ্রোতাদের সন্তুষ্ট করতে পারবে আর ত্রিশ বছরের রেওয়াজ তৃপ্তি দেবে তার গুরুকে কিন্তু যদি সে যথার্থ শিল্পী হতে চায় তাকে আরও অনেক বছর রেওয়াজ করে যেতে হবে তবে সে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে পারবে। তিনি নিজে তো আজীবন রেওয়াজ করেছেন। ১৯৭২ সালে বাবা আলাউদ্দীনের প্রয়াণ পর্যন্ত তাঁর কাছে তালিমও নিয়েছেন। সুরস্রষ্টা হিসেবে আলি আকবরের অসামান্যতা ধরা আছে নানান অ্যালবামে। হিন্দোল হেম, মেধাবী, মধুমালতী, মেঘ সারঙ্গ ইত্যাদি রাগ তিনি তৈরি করেছিলেন।
একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন আলি আকবর খাঁ। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মান। ঢাকা ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছিল সাম্মানিক ডক্টরেট। ১৯৯১ সালে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রসারে তাঁর অবদানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকআর্থার ফাউন্ডেশন জিনিয়াস ফেলোশিপ পেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট কেনেডির অভিষেক অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন আমন্ত্রিত শিল্পী।
শিল্পী হিসেবে অনন্য, রাগস্রষ্টা হিসেবে অবিস্মরণীয়, গুরু হিসেবেও তাঁর অবদান কম নয়। পন্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর কাছে তালিম নিয়েছিলেন। শরণরানী, ব্রিজভূষণ কাবরা প্রমুখের মতো না হলেও ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বই তাঁর কাছে তালিম নিয়েছেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন সঙ্গীত সবার জন্য। সঙ্গীতে সব ভেদাভেদ মুছে যায়, সঙ্গীত মনে শান্তি আনে, সেই মহান শিল্পী চলে গেলেন ২০০৯ সালের ১৮ জুন। শরীর খুব খারাপ থাকায় সোফায় হেলান দিয়ে গান গেয়ে ক্লাস নিচ্ছিলেন। শরীর আরও খারাপ হওয়ায় তাঁকে বিছানায় নিয়ে যাওয়া হলে তিনি ছাত্রদের দুর্গা রাগ গাইতে বললেন। দুর্গা শুনতে শুনতে রাতের অন্ধকার যেন তাঁকে ছুঁয়ে গেল। এক অনন্ত জগতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন দেবশর্মণ বংশোদ্ভূত ঈশ্বরের প্রসাদধন্য স্বরস্রষ্টা আলি আকবর খাঁ। ধ্যানমগ্ন শিল্পী পাড়ি দিলেন চিরসুরের, চিরমগ্নতার জগতে।
তাঁর জন্মের একশো বছরে এই অশান্ত পৃথিবীর কাছে তাঁর সুর অপার শান্তির আবহ বয়ে আনুক। সুরের স্পর্শে স্নিগ্ধ হয়ে উঠুক উত্তপ্ত ধরিত্রী।