পৃথিবীতে সবসময়ই উদাহরণ সৃষ্টিকারী মহৎ প্রাণেরা জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁরা অচিরেই তামসী রাতের কালো ছায়াকে ম্লান করে জ্ঞান ও মুক্তি’র আলো জ্বালিয়েছেন, বুঝিয়েছেন অন্ধকারই শেষ কথা নয়, অন্ধকারে থেকে নিজেকে উদ্ধার করে অপরকে আলোর দিশা দেখানোর অর্থই জীবন। সেইসব মহৎ প্রাণেদের মধ্যে অন্যতম একজন স্বর্ণকুমারী দেবী। কলকাতা জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের ঔরজা, সপ্রতিভ আলো। বাংলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য মহিলা সাহিত্যিক, কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতকার ও সমাজ সংস্কারক দের মধ্যে একজন।
সেসময় মহিলা কবি-সাহিত্যিকরা হয়তো সমাজ সংস্কারের পাষাণ বেদীকে সেভাবে টলাতে পারেননি, তবে সাংসারিক কাজকর্মের অবসরে তাঁরা দেখেছিলেন বৃহত্তর জীবনের দুঃসাহসিক স্বপ্ন। চেষ্টা করেছিলেন বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে। চেয়েছিলেন খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের পথ অতিক্রম করতে। সামাজিক মূল্যবোধ ও সমাজের ভালোমন্দ বিচার করেছিলেন তাঁরা নিজস্ব উপলব্ধির আলোয়। বিধি নিয়মের নির্মম বঞ্চনা গ্লানি ও দুঃসহ গুমোট জীবনই উচ্চারিত হয়েছিল তাঁদের লেখনীতে। স্বর্ণকুমারী দেবীর কলমও তাঁর ব্যতিক্রম ছিল না।
ঊনিশ শতকের শেষদিকে প্রাক স্বাধীনতা পর্বে নারী স্বাধীনতা, নারীমুক্তি, নারীবাদী, স্বাধীনতাকামী যে মহিলা কবির নাম সর্বাগ্রে এবং বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, তিনি স্বর্ণকুমারী দেবী। দীর্ঘ ৫০বছর ব্যাপী তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যই নয়, সৃষ্টির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির শিক্ষা, সংস্কৃতিবোধ ও বঙ্গজীবনের নবজাগরণ ভাবনার ঋদ্ধির ক্ষেত্রে স্বর্ণকুমারী ছিলেন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্না নারী।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একাদশতম সন্তান স্বর্ণকুমারী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িত ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের শিক্ষা বিষয়ে বিশেষ সচেতন ছিল। তিন বছর বয়সে অন্তঃপুরে থেকেই শুরু হয়েছিল স্বর্ণকুমারী দেবীর বিদ্যা-শিক্ষা। বাড়ির নিয়ম শৃঙ্খলা, উৎসব-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল মুক্ত মানসিকতা গঠনে তাঁকে সাহায্য করেছিল তো বটেই, সঙ্গে ছিল তাঁর স্ব-প্রতিভা। ‘সাহিত্য স্রোত’ –গ্রন্থে দেবেন্দ্রনাথ ও তাঁর বাল্যশিক্ষা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,
“তিনি মধ্যে মধ্যে অন্তঃপুরে আসিয়া আমাদিগকে সরল ভাষায় জ্যোতিষ প্রভৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন। তিনি যাহা শিখাইতেন তাহা আমাদিগকে নিজের ভাষায় লিখিয়া তাঁহারই নিকট পরীক্ষা দিতে হইত। ছাত্রীদিগের মধ্যে আমিই ছিলাম সর্বাপেক্ষা ছোট নগণ্য ব্যক্তি। সেইজন্য পরীক্ষাতেও সকলের সমান হইবার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্মিত। কিন্তু পরীক্ষার নম্বর আমরা কেহ জানিতে পারিতাম না। এইরূপে পিতৃদেব অন্তঃপুরিকাদের মধ্যে শিক্ষার বীজ বপন করিয়াছিলেন।”
১৭ নভেম্বর, ১৮৬৭ সালে জানকী ঘোষালের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিয়ে হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল তেরো। তাঁর সাহিত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কাজে উৎসাহ আর উদ্দীপনা সংযোগ করতেন তাঁর স্বামী। বিয়ের কিছুদিন পরই স্বামী কর্মসূত্রে বিলেত যান, কিন্তু স্বর্ণকুমারী থেকে গিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোতেই, সারাক্ষণ নিজেকে নিমগ্ন রাখতেন লেখালিখি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চর্চায়। স্বর্ণকুমারী তাঁর নিজস্ব জীবনের বিকাশে স্বামীর সহায়তার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন,
“আমার প্রিয়তম স্বামীর সাহায্য ও উৎসাহ ব্যতিরেকে আমার পক্ষে এতদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হইত না। আজ বহির্জগত আমাকে যেভাবে দেখিতে পাইতেছে, তিনিই আমাকে সেইভাবে গঠিত করিয়া তুলিয়াছিলেন এবং তাঁহার প্রেমপূর্ণ উপদেশে বা ঝটিকা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রেও যেমন সন্তরণনিপুণ ব্যক্তি সহজে ও অবলীলাক্রমে সন্তরণ করিয়া যায়, সাহিত্যজীবনের ঝটিকাময় ও উত্তাল তরঙ্গের মধ্য দিয়া আমিও সেইরূপ অবলীলাক্রমে চলিয়া আসিয়াছি।”
স্বর্ণকুমারীর বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় মেলে ‘ভারতী’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উৎসাহ ও উদ্যোগেই ‘ভারতী’ পত্রিকার প্রকাশ ঘটে। ‘ভারতী’ পত্রিকার অষ্টম বর্ষে এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তিনি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও স্বর্ণকুমারী এই তিনজন ‘ভারতী’ সম্পাদনা-চক্রের মধ্যে ছিলেন। এই পত্রিকার প্রথম প্রকাশকাল থেকেই গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে স্বর্ণকুমারী ছিলেন যোগ্য সঙ্গী। অন্যদিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন বিখ্যাত সুরকার। তাঁর প্রভাবে স্বর্ণকুমারী দেবীর সুর সাধনার প্রকাশ ঘটে। পিয়ানো বাজিয়ে নতুন-নতুন সুরের সৃষ্টি করতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের এই সুরগুলিকে কথায় বেঁধে রাখতেন স্বর্ণকুমারী।
বঙ্গমহিলাদের মধ্যে তিনিই বোধহয় প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক। উদার সমাজভাবনা প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কবিতা, গান –এসবের মধ্যেই শুধু নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নানাবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অতপ্রত যোগ ছিল তাঁর। কাশিয়াবাগানে থিয়জফিক্যাল সোসাইটির অধিবেশনে প্রতিনিধি হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। উনিশতম বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য শাখার সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। আবার ১২৯৩ সালে মাদাম ব্লাভাটস্কির দলভঙ্গের পরে ‘সখি সমিতি’ নামে স্বর্ণকুমারী মহিলা সমিতি স্থাপন করেন। উদ্দেশ্য ছিল- আলাপ পরিচয়, দেখাশোনা, মেলামেশা, স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তার ও উন্নতির চেষ্টা, বিধবা সাহায্য, অনাথকে আশ্রয়দান।
তাঁর আর একতি উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ছিল ‘মহিলা শিল্পমেলা’। বঙ্গদেশ, বোম্বাই, আগ্রা, জয়পুর, কানপুর থেকেও এই শিল্পমেলায় বহু শিল্পজাত দ্রব্য আসত। এই শিল্পমেলা প্রসঙ্গে তাঁর ‘বিধবা শিল্পাশ্রম’ গঠন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্ব্বাণ’। বিয়ের পরেই লিখেছিলেন এটি। পৃথ্বীরাজ মহম্মদ ঘোরীর সংঘর্ষ কাহিনী নিয়ে এই উপন্যাস। টডের গ্রন্থ থেকে স্বর্ণকুমারী এই উপন্যাসের উপাদান পেয়েছিলেন। ‘ছিন্ন মুকুল’ তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘মিবাররাজ’। ‘হুগলীর ইমামবাড়ি’, ‘বিদ্রোহ’ তাঁর অন্যতম ঐতিহাসিক উপন্যাস। সামাজিক উপন্যাস ‘স্নেহলতা’। ঐতিহাসিক রোমান্টিক প্রেমের উপন্যাস ‘ফুলের মালা’।
স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘কাহাকে’ উপন্যাসটি বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ‘কাহাকে’ উপন্যাসটি শুধু বাঙালী সমাজে নয় বিদেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তাঁর ২টি উপন্যাস, ১৪টি গল্প ও ১টি নাটক অনূদিত হয়। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় সংস্করণ ‘টু হুম’ নামে কলকাতায় প্রকাশিত হয়। ‘দিব্য কমল’ নাটকটি অনূদিত হয় জার্মান ভাষায় ‘প্রিন্সেস কল্যাণী’ নামে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি ছোট গল্প সংকলন ও ‘শর্ট স্টোরিজ’ নামে ইংরেজী অনুবাদ করা হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মহিলা গীতিকবিদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী দেবী সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি যে কাব্যগ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘গাথা’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ। তাঁর কবিতা ও গানে প্রভাত সঙ্গীত, মধ্যাহ্ন সঙ্গিত ও নিশীথ সঙ্গীত রয়েছে। ‘গাথা’ কাব্যগ্রন্থটি তিনি উপহার দিয়েছিলেন তাঁর স্নেহের ছোট ভাই রবি কে। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ১৯। অনেকেই মনে করেন ভাই রবীন্দ্রনাথের উপর তাঁর বেশকিছু প্রভাব পড়েছিল। এই গ্রন্থে মোট ৭৪ টি কবিতা এবং গান রয়েছে ৯৯ টি এর মধ্যে জাতীয় সঙ্গীত ৬টি ও ১৪টি ধর্ম সঙ্গীত রয়েছে। প্রভাত সঙ্গীত প্রথম কবিতা ‘প্রভাত’। এই কবিতার কয়েকটি লাইন এইরকম-
“অরুণ মুকুট শিরে,
অধরে ঊষার হাসি,
পদতলে প্রস্ফুটিত
শত শত ফুল-রাশি!”
স্বর্ণকুমারীর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধগুলিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি যে বিজ্ঞানের অনুরাগী পাঠক ছিলেন তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় ‘তারকা জ্যোতি’, ‘নীহারিকা’, ‘সূর্য’, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধে। তাঁর ‘বৈজ্ঞানিক সংবাদ’ সংকলন অংশে পাশ্চাত্যের বহু বিজ্ঞানীরদের গবেষণার স্থান পেয়েছে।
১৯২৭ সালে তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিনী' স্বর্ণপদকে ভূষিত করা হয়। ১৯২৯ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি হন। সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখতে হয়ত তাঁকে সাহায্য করেছিল তাঁর ব্যক্তিগত পরিবেশ-পরিস্থিতি-মানুষজন। তবে সবই সম্ভব হয়েছিল তাঁর স্ব-চেষ্টায়। অনেক অবগুন্ঠনার কাছে প্রেরণা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পরিশেষে স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পর্কে গবেষক গোপাল হালদারের একটি মন্তব্য উল্লেখ করব, যা তাঁর উপযুক্ত সারাংশ। তাঁর কথায়-
“বাংলা সাহিত্যে স্বর্ণকুমারী দেবি প্রায় Matriarch ;
সত্যি রীন্দ্রনাথের যোগ্য অগ্রজ মনে, মতে, লেখায় ; সাহিত্যে
আধুনিক যুগের নারীর জীবন্ত আবির্ভাব।”