বাড়ি সংস্কৃতির পীঠস্থান। বাড়ি ভর্তি দিকপাল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা। সাহিত্য থেকে শিল্প সংস্কৃতি সবেতেই হওয়া বদল এনেছিলেন তাঁরা। যোগ হয়েছিল নতুন নতুন ধারা। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তাঁর কৃতিত্ব স্পর্শ করতে পারেননি কেউ।
স্বর্ণকুমারী দেবী।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের নাতনী। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা।
১৮৫৫ সালের ২৯ অগস্ট জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে জন্ম। তাঁর আগে তিন দিদি। সৌদামিনী, সুকুমারী ও শরৎকুমারী। সকলেই কৃতি। সৌদামিনী ছিলেন বেথুন স্কুলের প্রথম যুগের ছাত্রী। কিন্তু ছোট থেকেই স্বর্ণকুমারী একেবারে অন্যরকম।
ভিন্ন ধরনের মেধাবী। দেবেন্দ্রনাথ শুরু থেকেই সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যাপারে কড়া খেয়াল রাখতেন। কিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়াত না।
স্বর্ণকুমারী দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, তাঁদের বাড়িতে এক শিক্ষিকা শ্লেটে লিখে দিতেন। সেই লেখা নিজেদের শ্লেটে অনুকরণ করতেন তাঁরা। দেবেন্দ্রনাথ এ কথা জানতে পেরেই তিনি অযোধ্যানাথ পাকড়াশি নামে এক দক্ষ শিক্ষককে নিয়োগ করে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করেন।
ঠাকুরবাড়ির সাংস্কৃতিক কর্ম কান্ড প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। সেই সময় জ্যোতি ঠাকুর কাছে টেনে নেন সহোদরাকে।
স্বামী জানকীনাথ তখন সবে বিলেত গিয়েছেন। একা স্বর্ণ ঠাকুর বাড়িতে। মেতে উঠলেন জ্যোতি দাদার নতুন নতুন কাজের সঙ্গী হয়ে।
লিখতে ভালোবাসতেন। তবে তাঁর টান বিজ্ঞান আর দেশপ্রেমের দিকে। গম্ভীর, অন্তর্মুখী স্বভাব ডুবে সৃষ্টির খেয়ালে। একদিন প্রকাশিত হল তাঁর লেখা। প্রথম উপন্যাস ‘দীপ নির্বাণ’। সালটা ১৮৭৬।
দেশের জাতীয়তাবাদের আঙ্গিকে ইতিহাসের কাহিনি। পৃথ্বীরাজ আর মহম্মদ ঘোরীর যুদ্ধ ধরেছিলেন নিজের ভাবনায়। কাগজে- কলমে।
সেই উপন্যাস পড়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ পর্যন্ত অবাক হয়েছিলেন। কাগজেও এসেছিল প্রশংসা। উনিশ শতকের জনপ্রিয়তম গীতিকবিও তিনিই।
স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা ঔপন্যাসিক।
বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন। বিজ্ঞানের ইংরেজি শব্দগুলোকে যথাযথ পরিভাষা দেওয়া তাঁর খুব প্রিয় কাজ ছিল।
বাড়ির আবহাওয়ায় গান থেকে কী দূরে থাকা যায়! গানও লিখেছিলেন তিনি। সুরের সঙ্গে কখনও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব বাঁধেনি।
ঠাকুর বাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি সেই পত্রিকার দ্বিতীয় সম্পাদক। একটানা এগারো বছর ধরে তাঁর ঘামে-শ্রমে 'ভারতী' হয়ে উঠেছিল সেই সময়ের আকর্ষণ। লেখা নির্বাচনে থাকত সম্পাদিকার নিজের মুক্ত চিন্তার ছাপ।
স্বর্ণকুমারী নিজেকে কখনও অন্দরে আগলে রাখার কথা ভাবেননি। শুরু থেকেই তিনি মুক্তমনা। অন্যরকম ধী’র মানুষ।
যুক্ত হয়েছিলেন রাজনীতির সঙ্গেও। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনিই ছিলেন প্রথম মহিলা যিনি জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বহুমুখী বিস্তার ছিল জীবনে। শুরু থেকেই অন্য রকম। প্রথা ভাঙার প্রতীক। শিল্পচর্চার প্রতি টান ছিল। সেই টানকে তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন বহু মানুষের সেবায়। মহিলাদের বাণিজ্য এবং শিল্পচর্চায় উৎসাহ দিতে শুরু করলেন 'মহিলা শিল্পমেলা'। বাংলা এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহিলাদের তৈরি শিল্পকাজ আসত সেই মেলায়। প্রদর্শন হত। সেই সূত্রেই গড়ে তোলেন ' বিধবা শিল্পাশ্রম'।
কর্মমুখর জীবনে সদা সৃষ্টিশীল থেকেছেন। সাহিত্য থেকে সমাজ যে কোনও ক্ষেত্রেও তিনি গঠনমূলক। ঠাকুর বাড়ির উজ্জ্বল আলোকে, চোখ ধাঁধানো বিভায় তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি চিরকাল আপন দ্যুতিতে উজ্জ্বল এবং স্বতন্ত্র।