স্বামী বিবেকানন্দ একাধারে সাধক, পরিব্রাজক, সন্ন্যাসী, সংগঠক, দার্শনিক, ধর্মপ্রচারক, সাহিত্যিক, আড্ডাবাজ ও সুরসিক। তিনি রসিকপ্রবর রামকৃষ্ণের চ্যালা। রসিকপুরুষ বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র। কাজেই তিনি যে সুরসিক হবেন তাতে আর বিচিত্র কী!
তবে বিবেকানন্দের রসিকতায় উইটের পরিচয় যতটা আছে, তার চেয়ে খুনসুটির পরিমাণ আছে বেশি। তাঁর অন্তরে একটি আদ্যন্ত সরল অথচ দুরন্ত শিশু যে আজীবন বাস করত, তার সুমধুর পরিচয় বহন করে তাঁর খুনসুটিগুলি।
গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের রসিকতায় ছিল উইটের দিলখোস। বিবেকানন্দের পরিব্রাজক জীবনের বিভিন্ন ঘটনায় তার যথেষ্ট পরিচয় মেলে। তিনি যেখানেই যেতেন সাধুসঙ্গের জন্য আকুল হতেন। একবার ঋষিকেশে ঘুরতে ঘুরতে আলাপ করতে গেলেন এক সাধুর সঙ্গে। সাধু সব ছেড়ে প্রথমেই তাঁর 'সম্প্রদায়'-এর খোঁজে লাগলেন। জিজ্ঞেস করলেন, 'গিরি, না পুরী?' তাই শুনে প্রগলভ হলেন স্বামীজি। মুচকি হেসে জবাব দিলেন, 'কচুরি!'
তবে বিবেকানন্দ খুনসুটির উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন পিতা বিশ্বনাথের কাছ থেকে। কেননা, ছেলেমেয়েরা অন্যায় দুষ্টুমি করলে তাদের মেরেধরে শিক্ষা দেওয়ায় বিশ্বাস করতেন না বিশ্বনাথ। শিক্ষা দিতে তিনি উল্টে আশ্রয় নিতেন খুনসুটিরই।
সেটা কীভাবে? বলছি:
এই যেমন ধরুন, মা ভুবনেশ্বরীর সঙ্গে ছোট্ট নরেন্দ্রনাথের একপ্রস্থ ঝগড়া হয়ে গেল একদিন। আর-পাঁচজন ছেলেমেয়ের নানান বায়না নিয়ে মা'র সঙ্গে যেমন হয় আর কী। তো, ঝগড়া করে রেগেমেগে দারুণ অভিমানে বেশ কিছু কটু কথা মাকে শুনিয়ে দিলেন নরেন। মা অমনি নালিশ করলেন বাবার কাছে। বাবা তাই শুনে ঘরের দেওয়ালে কাঠকয়লায় সরসর করে বড় বড় হরফে লিখে দিলেন যে, নরেন তাঁর মাকে এই-এই বাজে কথা বলেছে। দেওয়ালটিও এমন দেওয়াল যে, বাইরে থেকে ঘরে কেউ ঢুকলেই প্রথমেই তাঁর চোখ পড়বে সেই লেখায়।
বিশ্বনাথ আইন ব্যবসায়ী মানুষ। প্রতিদিন তাই তাঁর ঘরে অনেক সম্ভ্রান্ত-বিভ্রান্ত লোকের যাতায়াত। সুতরাং, সেদিন বাইরের লোক যিনিই আসছেন, তিনিই প্রথমে লেখাটি পড়ছেন, মুচকি হাসছেন, তারপর বিশ্বনাথের দপ্তরে ঢুকছেন; আর নরেন তাই দেখে কেবলই মরমে মরছেন! আর মনে মনে ভারি আফসোস করছেন, ইস, মাকে বাজে বাজে কথা বলা সত্যিই উচিত হয়নি। আর কোনদিন অমন করে বলব না, কক্ষনো না!
এই হচ্ছে শুরু। তারপর শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের পর তাঁর শিষ্য ও অনুগামীদের সংঘে বেঁধে বিবেকানন্দ যখন গড়ে তুললেন মঠ; তখন মঠের অনুশাসন ও সন্ন্যাসীর কৃচ্ছ্র শেখাতে স্বামীজি পিতার দেখানো পথটিরই আশ্রয় নিলেন।
মঠ তখন তৈরি হয়েছে বটে, তবে নিজস্ব স্থান জোটেনি, চলছে নীলাম্বর মুখার্জির আশ্রয়ে। তাতেই স্বামীজির জ্ঞান ও ব্যক্তিত্বের টানে, শ্রীরামকৃষ্ণ-দর্শনের সন্ধানে অনেকগুলি শিক্ষিত যুবা গৃহত্যাগ করে মঠে ব্রহ্মচারী হয়ে যোগ দিয়েছেন। স্বামীজি তাঁদের শাস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছেন, শরীরশিক্ষা দিচ্ছেন। একদিন হল কী, রাত্রি দুটো অব্দি তাঁদের দুটো দলে ভাগ করে পুনর্জন্ম বিষয়ে বেদান্তের ফ্যাকড়া তুলে বিষম তর্ক বাঁধিয়ে বেশ আমোদ উপভোগ করলেন। তারপর তাঁদের শুতে পাঠালেন।
স্বামীজির রাত্রে তেমন ঘুম হত না। খানিক এপাশ-ওপাশ করে তিনি চারটের আগেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। তারপর গুনগুন করে গান গেয়ে খানিক পায়চারি করে চারটে বাজিয়ে স্বামী অখণ্ডানন্দকে ঘুম থেকে তুললেন। তিনিই সকালে ঘন্টা বাজিয়ে সকলকে ঘুম থেকে তোলেন। তাই স্বামীজি তাঁকে বললেন, দে ব্যাটা ঘন্টা বাজিয়ে, সবাই উঠে পড়ুক!
কিন্তু অখণ্ডানন্দ ঘড়ি দেখে থ। সবে চারটে বাজে, এই তো খানিক আগেই দুটোর সময় সকলে ঘুমোতে গেল! এখনই তুলব?
যেই না সে-কথা স্বামীজিকে বলা, অমনি স্বামীজি তিরিক্ষে হওয়ার ভান করে বললেন, হ্যাঁ তুলবি, দুটোর সময় শুয়েছে বলে ছ'টায় উঠতে হবে নাকি! ঘুমোবার জন্য তো আর মঠ করা হয়নি! ঘন্টা বাজাবি, না আমিই বাজাব!
এরপর অখণ্ডানন্দ আর কী-ই বা করেন, দিলেন ভোর রাতে সজোরে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে। অমনি সাধের কাঁচাঘুমটি ভেঙে সকলেই বেশ তিরিক্ষে হয়ে 'হৈ রে হাঁই রে' করে তেড়ে এলেন। কিন্তু সামনেই স্বামীজিকে হো হো করে হাসতে দেখে প্রত্যেকেই বেশ দমে গিয়ে লজ্জিত হলেন।
আসলে, কৃচ্ছ্রের শিক্ষা দিতে কঠোর হতেই হয়। সেই কঠোরতার সঙ্গে যদি রসময় আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকে, তাহলে সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে দেরি হয় না। স্বামীজি এটা বেশ ভালোভাবেই জানতেন। তাছাড়া এসব তাঁর গুণাবলীর একটা দিকও বটে। তাই মঠের ছোটবড় কারুর প্রতি কোন ভেদ তাঁর ছিল না, সকলকেই তিনি সমান চোখে দেখতেন। নিজে যেমন খুনসুটি করতে পছন্দ করতেন, তেমনি অন্যের খুনসুটির মধ্যে যদি সদুদ্দেশ্য থাকত, তবে তাকেও তিনি প্রশ্রয় দিতেন।
সত্যি বলতে কী, যেখানে শিক্ষা, সেখানেই তিনি; যেখানে আনন্দ, সেখানেই তিনি। শিক্ষা দিয়ে প্রতিকূলতার মাঝে বিবেক ও আনন্দকে জাগিয়ে রাখাই যে তাঁর ব্রত। কেননা, তিনি যে 'বিবেকানন্দ'...
তথ্যঋণ :
'শ্রী শ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ' - স্বামী সারদানন্দ।
'স্মৃতির আলোয় স্বামীজি' - স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ।