আহারে বিবেকানন্দ

বাপের বৈঠকখানায় হরেক গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে বাল্যেই বিলে বুঝে গিয়েছিলেন যে, এঁটোকাটা-ছোঁয়াছুঁয়িতে জাত যাওয়াটা একটা বিশিষ্ট ঢপ ছাড়া আর কিচ্ছু না।  তাই উত্তরাশ্রমের বিবেকানন্দ দীক্ষা দিয়ে শিষ্যদের বলতেন, "আজ হতে তোকে ছত্রিশ জাতের অন্ন খাবার অধিকার দেওয়া হলো।" আসলে,  বিশ্বনাথ দত্তের রসুইখানায় মুসলমান বাবুর্চি ছিল, এবং শৈশব থেকেই নরেন বিশিষ্ট মাংসাশী। তাঁর গুরু রামকৃষ্ণদেবও জানতেন যে, তাঁর প্রিয় শিষ্যটির রসনারস থেকে মুরগি-পাঁঠা-মাছ-পোলাও কিচ্ছু বাদ যায় না।  চিড়বিড়ে ঝাল তাঁর খুব পছন্দ। মিষ্টি দু'চোখের বিষ।

ঋষিকেশে গুরুভাইরা মিলে ঝুপড়ি বেঁধে ঘোর তপস্যা চলছে। তার মধ্যে নরেন আবার জ্বরে পড়লেন। মুখে কিছু রোচে না। তবু ইচ্ছে হল খিচুড়ি খাবার। অমনি চাল-ডাল ভিক্ষে করে খিচুড়ি বসানো হল। আচ্ছা করে লঙ্কা দেওয়া হল। ভিক্ষেয় খানিকটা মিছরি পাওয়া গিয়েছিল। রাখাল মহারাজ ছেলেমানুষ। ভাবলেন, এটা আর পড়ে থাকে কেন। খিচুড়িতে দিয়ে বসলেন।  ব্যস, মিষ্টি খিচুড়ি মুখে তুলতেই নরেনের নাক সিঁটকে গেল। জ্বর গায়েই রাখালকে আচ্ছা করে বকে দিলেন, "যা: শালা! খিচুড়িতে কখন মিছরি দেয় রে? শ্যালা তোর একটু আক্কেল নেই?"

মিরঠে এক আমীর সাহেব নরেনের পণ্ডিত্যের কথা শুনে দেখা করতে এলেন। ইসলামশাস্ত্রে নরেনের অসাধারণ পণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়ে তিনি তো মুগ্ধ। গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে তিনি কিছু সিধে পাঠিয়ে দিলেন। নরেন তা-ই দিয়ে নিজের হাতে মাংস-পোলাও রান্না করলেন। দারুণ সুস্বাদু রান্না হল। এখানেই তাঁর হাতে আজন্ম নিরামিষভোজী হরি মহারাজের আমিষে অভিষেক হল। সিমলা স্ট্রিটে বিশ্বনাথ দত্তের বাবুর্চিরা হামেশাই মাংস-পোলাও করতো। তাদের কাছেই নরেনের শিক্ষা। তাছাড়া, কলেজে পড়তে ফরাসি রান্নার বই কিনে এটা-সেটা প্রায়ই বানাতেন। এভাবে রামকৃষ্ণ-সান্নিধ্যে আসার সময় থেকেই তিনি পাক্কা রাঁধুনি।

তিনি তখন বোম্বেতে। প্রথমবার বিদেশে যাবার প্রস্তুতি চলছে।  একদিন খুব ইচ্ছে হল, কই মাছ খেতে।  বোম্বাই নগরে এ-মাছ তখন পাওয়া যেত না। কী করা যায়, কী করা যায়! শেষমেশ তাঁর ভক্ত কালীপদ ঘোষ অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বম্বের বাইরে থেকে সে-মাছ জোগাড় করে আনালেন। তাই দেখে নরেন শিশুর মতো খুশি। সেই খুশির চোটে নিজের প্রিয় বেতের লাঠিটাই উপহার দিয়ে ফেললেন কালীপদকে।

কি পূর্বাশ্রম, কি সন্ন্যাসাশ্রমে উপবাস-অনাহারে শরীর ক্ষয় করাটাকে মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেকানন্দ মনে করতেন না। সমস্ত রকম প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়তে হলে আগে সবল শরীর চাই। আর সেই শরীর রাখতে নিয়মিত আমিষ আহার এবং শরীর চর্চার প্রয়োজন আছে বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন। মঠ স্থাপিত হলে তিনি তাই এ-দু'য়েরই ওপর জোর দিয়েছিলেন। এজন্য অনেক বিরুদ্ধতার গণ্ডি তাঁকে পেরোতে হয়েছে। তবে, অনাহারে-অর্ধাহারের দিন তাঁর জীবনেও এসেছিল। রামকৃষ্ণদেব দেহরক্ষার পর।  গুরুভাইদের নিয়ে তখন নরেন পড়লেন দারুণ দুর্দশায়। অর্থ নেই, আশ্রয় নেই। বরাহনগরের এক পোড়ো বাড়িতে প্রথম মঠ স্থাপিত হল। আহারের জন্য সম্বল হল, ভিক্ষা। ভিক্ষার চালের ভাত একটা কাপড়ে ঢেলে দেওয়া হতো। সবাই মিলে সেটা ঘিরে বসতেন। সঙ্গে,  নুন ও লঙ্কার ঝোল। কোনদিন বা তেলাকুচা পাতার ঝোল। এক গাল শুকনো ভাত আর ঝোলে আঙুল ডুবিয়ে চেটে নেওয়া। ব্যস, ঝালের চোটেই 'হু হা' করে ভাত খাওয়া হয়ে যেত। দীর্ঘদিন চলল এই দুর্দশা, এমন অনিয়ম। তাতেই নরেনকে ক্রনিক পেটের রোগে ধরল।।

পেটের অসুখ একবার খুব বেড়ে গেল। বলরাম বসু তাঁকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। পথ্য হল, সাগু-বার্লি। তাঁর মতো মানুষের এতে পোষায়? বলরামের বাড়িতে ভাবিনী নামের এক বিধবা আশ্রিতা ছিলেন। তিনি রামকৃষ্ণদেবকে পিঠে খাইয়ে তৃপ্ত করেছিলেন। তাঁর কাছে নরেন আবদার করলেন, রুটি আর কুমড়োর ছক্কা খাবেন। ভাবিনী এ অনুনয় ঠেলেন কেমন করে! বলরামকে লুকিয়ে ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু, খাওয়ার খবর চাপা রইলো না। খবর পেয়ে বলরাম দুজনকেই খুব বকলেন। তবে কপাল ভালো সে-যাত্রা বাড়াবাড়ি কিচ্ছু হয়নি, উল্টে বিষে বিষে বিষক্ষয় হয়েছিল। পেটের অসুখ এক্কেবারে সেরে গিয়েছিল!

গুরুভাই বা শিষ্যদের প্রতি বিবেকানন্দের স্নেহ-ভালোবাসা ছিল অফুরন্ত। এই ভালোবাসা থেকেই তাঁদের ওপর রাগ করতেন। আবার বেদানা বা অন্য কোন ফল খেতে গিয়ে তাঁদের মধ্যে যাঁর কথা মনে হতো, তাঁর জন্য তুলে রেখে দিতেন। আর চাইতেন সবাই যেন স্বাবলম্বী হতে পারেন। তার জন্য যাঁরা রাঁধতে জানেন না, তাঁদের নিজের হাতে রান্নাও শিখিয়েছেন। 

জাতপাত ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে কোন সংস্কার না-থাকলেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে কড়া নজর ছিল বিবেকানন্দের। একদিন স্বামী অচলানন্দকে বলেছিলেন, "দেখ, তোর নখে যদি ময়লা থাকে, তবে তোর হাতে জল খাবো না।" পরার কাপড়ে হাত মুছে খাবার দিতে গেলেও রাগ করতেন। আসলে, এসব করতেন নতুনদের শিক্ষা দিয়ে গড়েপিটে নেবার জন্য। তার বাইরে তিনি কিন্তু ভেদাভেদ শৌচ-অশৌচের অনেক ঊর্ধের মানুষ। তিনি মানব-প্রেমিক, ভোজন-রসিক। তাই তো তিনি অনায়াসে পরিব্রজনের সময় মেথরের হাত থেকে কল্কে নিয়ে হুঁকো খেতে পারেন, আলোয়ারের রাজার অতিথি হয়েও বৃদ্ধার ঝুপড়িতে বসে পাঁচ মিশালী আটার টিক্কর-রুটি খেতে পারেন; কিংবা কোন গুণমুগ্ধকে অবলীলায় বলতে পারেন, "তোমার বাড়ি গেলে কি খাওয়াবে?"

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...