"তোমরা, তোমরা কী?... তোমাদের সারা জীবন বাজে বকিতেছ, অনর্থক প্রলাপকারীরা, তোমরা কী? ... লজ্জায় তোমাদের মুখ ঢাকো। জড়বুদ্ধিসম্পন্ন জাতি, তোমরা তোমাদের প্রাসাদ হারাবে যদি তোমরা বাইরে আসো! শত শত বছর ধরে তোমাদের মাথার উপর দানা বাঁধা কুসংস্কারের ক্রমবর্ধমান বোঝা নিয়ে বসে আছো, শত শত বছর ধরে এ খাবার সে খাবারের স্পর্শযোগ্যতা বা স্পর্শ-অযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করে তোমাদের সকল শক্তি ক্ষয় করছ, যুগ যুগ ধরে অবিরাম সামাজিক পীড়নের দ্বারা তোমাদের সকল মানবিকতা নিষ্পেষিত - তোমরা কী? ... তোমরা এখন কী করছ?... ত্রিশ রুপিয়ার কেরানির চাকরির জন্য সমস্ত আত্মা অবনত, অথবা বড় জোর একজন উকিল হওয়া; তোমাদের, বইগুলোর, গাউনের, বিশ্ববিদ্যালয় ডিপ্লোমাগুলোর আর সব কিছুর ডোবার জন্য সমুদ্রে যথেষ্ট জল কী নেই?"...
এই কথাগুলো যার কলম থেকে বেরিয়েছে তাঁর পরিচয় এই তুচ্ছ আর্টিকেল লিখিয়ে আর কী দেবে? ইনি শুধু বাংলার নন... সারা ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মণীষী। ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের শ্রেষ্ঠ শিষ্যটির নাম ভারতের কেন, সারা বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষই জানেন।
তিনি শুধু এই নিবন্ধকারের নন, বেশিরভাগ বাঙালির আদর্শ। আসলে তিনি আমাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। তিনি যেন হাত তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেছেন: "হে বৎস, যথার্থ ভালবাসা কখনও বিফল হয় না। আজই হউক, কালই হউক, শত শত যুগ পরেই হউক, সত্যের জয় হইবেই, প্রেমের জয় হইবেই"...
তথাকথিত রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের নিয়মনীতি বা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে তাঁর বিশেষ বিশ্বাস ছিল না। যুবকদের উদ্দেশ্যে তাঁর কথা..."বসে গীতা পড়ার থেকে মাঠে ফুটবল খেলা অনেক ভালো"..
তিনি সর্বত্যাগী, সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী। কিন্তু গর্ভধারিণী জননীর প্রতি তাঁর অত্যাধিক ভালোবাসা এবং টানের কথা কখনো অস্বীকার করেন নি তিনি।
দেশের এবং বিদেশের বিখ্যাত এবং বিশিষ্ট মানুষরা ও তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন "আধুনিক ভারতের স্রষ্টা".. মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন "তাঁর রচনা গান্ধীজীর দেশপ্রেম সহস্রগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল"। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রোমা রোলাঁকে বলেছিলেন সেই মানুষটির রচনা পড়লে প্রকৃত ভারতবর্ষকে জানা যাবে।
তিনি ছাত্রাবস্থায় পড়তেন জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশনে (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ)। সেখানকার তৎকালীন প্রিন্সিপাল উইলিয়াম হেস্টি লিখেছেন, “ আমি বহু দেশ দেখেছি, কিন্তু তার মতো প্রতিভা ও সম্ভাবনাময় ছাত্র দেখিনি; এমনকি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দর্শন ছাত্রদের মধ্যেও না।"...
নিজের সহযোগী শিষ্যদের বলতেন "দরিদ্র ও নিচু শ্রেণির ঘরে ঘরে যাও এবং তাদের ধর্মশিক্ষা দাও। ভূ-বিজ্ঞান এবং অন্যান্য বিষয়েও তাদের মৌখিক শিক্ষা দিও। অলসভাবে বসে থেকে, রাজকীয় খাবার খেয়ে আর "রামকৃষ্ণ, ও প্রভু!" বলে ভালো কিছু হবে না যদি না তুমি দরিদ্রদের জন্য ভালো কিছু করতে পারো।"
এই মহামানব "শিব জ্ঞানে জীব সেবা" করতেন। বলেছিলেন "মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের বাস। মানুষের সেবা করলেই ঈশ্বরের আরাধনা করা হবে"
মানুষের কল্যাণ এবং সার্বিক উন্নতিতে কাজ করার জন্য তিনি হাজার বার জন্মগ্রহণে রাজি ছিলেন। এর জন্য নরকে যেতেও তিনি তাঁর আপত্তি ছিল না। অজ্ঞ, পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজে, তাদের স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে তিনি অটল ছিলেন ।
তিনি.... স্বামী বিবেকানন্দ। সম্ভবতঃ ভারতের শ্রেষ্ঠ মণীষী তিনি। আজ... তাঁর একশো ঊনষাটতম জন্মদিনে এই যুগমানবের চরণে সকল বাংলাবাসীর বাংলাভাষীর প্রণাম।
তথ্য ঋণ: বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ এবং
বিবেকানন্দ রচনাবলী