বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েছে শরীর। তবে দুর্বল নন। সাদা ধুতি আর সাদা ফতুয়ায় তরতরিয়ে হাঁটেন। গতি দেখলে বোঝা যায় এককালে কর্মঠ ছিল শরীর। তোবড়ানো গাল। দাঁত নেই। মাথায় শিখী। গলায় কণ্ঠী। কপালে রসকলী।
এমন মানুষটি যখন খালি পায়ে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন মঞ্চের সামনে হাঁ হয়ে গিয়েছিল রাষ্ট্রপতি ভবনের গোটা দরবার হল। এগিয়ে এসে ভূমি ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন তিনি। উঠে দাঁড়িয়েছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ অবাক ১২৫ বছর পার করা এক বৃদ্ধের এমন এগিয়ে আসা দেখে। অবাক হয়েছিল দেশও। তিনিই দেশের প্রবীণতম পদ্মশ্রী প্রাপক।
২০২২ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয় তাঁকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মুহূর্তে ভাইরাল! টেলিভিশন, সংবাদপত্র রাতারাতি শিরোনামে তিনি। অনেকেই দাবী করেছিল পৃথিবীর প্রবীণতম তিনিই। কিন্তু যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি চর্চায় ছিল তা তাঁর ১২৫ বছর সুস্থ নীরোগ জীবনের রহস্য কী!
তাঁর আসল নাম শিবানন্দ। মানুষ চেনে স্বামী শিবানন্দ নামে। থাকেন বারাণসীর দুর্গা মন্দিরের কাছে একটা এক কামরার ঘরে। সরকারী তথ্য বলে তাঁর জন্ম ১৮৯৬ সালের ৮ আগস্ট। অবিভক্ত বাংলাদেশের সিলেট জেলায়।
চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা। বাবা-মা দুজনেরই পেশা ছিল ভিক্ষাবৃত্তি। শিবানন্দের যখন ৬ বছর বয়স তখন প্রায় একসঙ্গে হারাতে হয় বাবা, মা আর দিদিকে। সূর্যোদয়ের আগে মা, সূর্যাস্তের পর বাবা। আর তার কিছুদিনের মধ্যেই বড়দিদি।
সহায় সম্বলহীন বালক শিবানন্দ নবদ্বীপ হয়ে যান বৃন্দাবন, সেখান থেকে পাড়ি দেন বারাণসী। শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তাঁর গুরু ওমকারানন্দের। তিনি তাঁকে যোগের পাঠ দেন। ৩০ বছর ধরে কাশীর গঙ্গার তীরে যোগ অভ্যাস করে চলেন তিনি। সঙ্গে সেবা। অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে কুষ্ঠরোগীদের সেবা করে চলেছেন। প্রায় ৪০০-৬০০ রোগীকে সুস্থ করেছেন নিজের দায়িত্বে।
কঠোর নিয়মানুবর্তিতা আর যোগ চর্চায় বাঁধা তাঁর জীবন। নিয়ম মেনে চলা, মিতাহার তাঁকে দীর্ঘ সুস্থ, নিরোগ জীবন দিয়েছে। ভোর ৩ টে বাজলেই দিন শুরু হয়ে যায় তাঁর। কয়েকঘণ্টা কাটে প্রার্থনা আর ঈশ্বর সাধনায়। তিনি বলেন সুস্থ থাকতে শরীর চর্চার সঙ্গে সঙ্গে চাই মানসিক চর্চাও। যোগ সাধনা মানে শরীর-মনের চর্চা। শারীরিক কসরত আর প্রাণায়ম তাঁর জীবনের অঙ্গ।
তেলমশলা ছাড়া সিদ্ধ খাবার খান। একবার দিনে, আর একবার রাতে। মাঝখানে কিছু নেই। রুটি, ডাল সবজি- এই থাকে তাঁর আহার্য। সারাদিনে তিনলিটার জল খান। নুন আর তেল দুই-ই প্রায় এড়িয়ে চলেন। তাঁর সুস্থ ও নীরোগ জীবনের রহস্য এই খাদ্যাভ্যাস। সেবার কাছে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু এই রুটিনে এক দিনের জন্যও কোনও বদল আসেনি। দুধ, ফল কোনওটাই খান না। কেউ যদি ফল দান করে তাঁকে, তখনই একমাত্র ফল খান। তাঁর মতে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই ফল দুধ যোগানের সামর্থ্য নেই। প্রাতঃরাশের অভ্যাসও তাঁর নেই। তবে কমবয়সীদের জন্য তাঁর পরামর্শ প্রাতঃরাশ বাদ দেওয়া ঠিক নয়। খালিপেটে রোগ প্রতিরোধ করা যায় না।
কুষ্ঠ রোগীদের সেবা তাঁর কাছে ঈশ্বর সেবার মতোই। খাবার, ওষুধ, শীতবস্ত্র, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন তাঁদের জন্য। মানুষের নিঃস্বার্থ সেবা তাঁকে জীবনে শান্তি দিয়েছে। শিবানন্দ স্বামী বলেন, গোটা পৃথিবীটাই তাঁর ঘর। মানুষ তাঁর বাবা-মা। তাঁদের সেবাই তাঁর ধর্ম।
গিনেস বুক অফ রেকর্ডের তথ্য অনুযায়ী এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রবীণতম জীবিত ব্যক্তি জাপানের কানি তানাকা। তাঁর বয়স ১১৯। শোনা যায় শিবানন্দের অনুরাগীরা আবেদন জানিয়েছে তিনি প্রবীণতম এই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে।
দেশভাগ দেখেছেন। দেখেছেন অতিমারীর ভয়াবহতা। তিনি নিজেই এক জীবন্ত দলিল। তবে একেবারে ছোটবেলার কথা তেমন স্মরণে নেই আজ আর। তাঁর কথায় তাঁর গুরু ওঙ্কারানন্দ গোস্বামী তাঁকে যা শিখিয়েছেন, সেই দিয়েই চলছে তাঁর জীবন। জীবনী শক্তির জোর কী, এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে এই প্রবীণ সন্ন্যাসী বলেন, চাহিদাহীন জীবন। সব বয়সেই যোগঅভ্যাস বিশেষ করে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস-এর ব্যায়াম প্রতিদিন করা দরকার। মন স্থির থাকবে। যোগ সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বইও লিখেছেন তিনি। যোগেই হবে রোগমুক্তি এই তাঁর মর্মকথা