**"আমার কোনো গোপন দু:খ নেই, আমার হৃদয়ে কোনো দাগ নেই
পৃথিবীর সব আকাশ থেকে বেজে উঠেছে উৎসবের বাজনা।
সাদা শিউলির রাশি বড় স্তব্ধ, প্রয়োজনহীন, দেখলেই
বলতে ইচ্ছে করতো,
আমি কারুকে কখনো দু:খ দেবো না-
অন্তত এ-রকমই ছিলো আমার কৈশোরে
এখন অবশ্য শিউলি ফুলের খবরও রাখি না।।".*****
পাঠক, এই কবিতা কার লেখা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন। এমন কবিতা শুধু তিনিই লিখতে পারেন এবং খুব অনায়াসেই। তাঁকে আমরা সবাই চিনি এইসময়ের জনপ্রিয়তম লেখকদের একজন হিসেবে। যদিও তিনি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী সবকিছু রচনাতেই ছিলেন স্বচ্ছন্দ অর্থাৎ সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় ছিল তাঁর অনায়াস যাতায়াত।
**"কেউ কেউ ভালোবেসে ভুল করে, কেউ কেউ ভালোই বাসেনা
কেউ কেউ চতুরতা দিয়ে খায় পৃথিবীকে, কেউ কেউ বেলা যায়
ফিরেও আসে না "***
(কই, কেউ তো ছিল না)
তিনি যে কত বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন সে নিয়ে নতুন করে বলার মতো কিছু নেই। আমরা প্রতিদিন একটা সুন্দর জীবন বাঁচার জন্য, স্বপ্ন দেখার জন্য, আমাদের জীবনটাকে আরেকটু ভালোবাসার জন্য তাঁর লেখার আশ্রয় নিই।
....."ভালোবাসাকেই তার ধর্ম বলে মেনে এসেছে। ও বিশ্বাস করতো ভালোবাসার ওষুধ প্রয়োগ করে মানুষের সব অসুখ সারিয়ে তোলা যায়।".... নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
১৯৩৪ এর আজকের দিনে অর্থাৎ ৭ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত বাংলার (এখনকার বাংলাদেশের) ফরিদপুরে তাঁর জন্ম হয়েছিল। যদিও মাত্র চার বছর বয়সে তাঁর বাবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতাতেই তাঁর বড়ো হওয়া এবং পড়াশুনা। বাবা কালিপদ গঙ্গোপাধ্যায় মা মীরা গঙ্গোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন তিনি।
**"আমরা সবাই এই আকস্মিকতার সন্তান। পৃথিবীতে আসাটাই আকস্মিক, তবু সারাজীবন নানারকম যুক্তি দিয়ে এই জীবনটা সাজাবার চেষ্টা করি"***
( তাঁর আত্মজীবনী "অর্ধেক জীবন")
রসবোধের তুলনা হয় না তাঁর। আত্মজীবনীতে লিখছেন তিনি
.."আমার ধাইয়ের নাম ছিল বোঁচার মা।.. তাঁর নিজের নাকটিও খুব বোঁচা ছিল। চক্ষু উণ্মীলনের পর সেই রমনীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার নাকটিও বোঁচা হয়ে যায়। আমার মায়ের অমন সুন্দর টিকোলো নাক, কে বলবে আমি তাঁর সন্তান।"....
কোলকাতাতে তাঁর বড়ো হওয়া। সতেরো বছর বয়সে দেশ পত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রথম ছাপা হয়। তাঁর বাবা প্রতিদিন তাঁকে টেনিসনের দুটো করে কবিতা অনুবাদ করতে দিতেন। তিনি কিছুদিন অনুবাদ করলেন ঠিকই কিন্তু তারপর নিজেই কবিতা লেখা শুরু করলেন।
**কাচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে
দুটো চারটে নিয়মকানুন ভেঙে ফেলি
পায়ের তলায় আছড়ে ফেলি মাথার মুকুট *** (ইচ্ছে)
এম এ পাশ করার পর একটা স্কলারশিপ পেয়ে আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। ইচ্ছে করলেই তিনি সেখানে থেকে যেতে পারতেন কিন্তু বাংলা ভাষা আর কোলকাতা শহরটাকে এতোই ভালোবাসতেন যে তাদের টানে আবার ফিরে এলেন এখানেই।
***"আমার যা ভালোবাসা, কাঙালের ভালোবাসা, এর কোন মূল্য আছে নাকি"****
দেশ পত্রিকায় ১৯৬৩তে তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়..."আত্মপ্রকাশ"... সত্যিই আত্মপ্রকাশ ঘটলো এক এমন লেখকের যে মানুষ পরবর্তী সময়ে... তাঁর জীবিতকালে তো বটেই... মৃত্যুর আটবছর পর ও বাংলা সাহিত্যের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলজ্বল করছেন। দুবার তিনি পেয়েছিলেন আনন্দ পুরস্কার। "সেই সময়" উপন্যাসের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিলো তাঁকে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সাহিত্য আকাদেমির সভাপতি ছিলেন। তবুও তাঁর মনে হয়েছে শ্রেষ্ঠ লেখাটি হয়তো বাকিই রয়ে গেছে...
****একটা কথা বাকি রইলো থেকেই যাবে
মন ভোলানো ছদ্মবেশী মায়া
আরেকটু দূরে গেলেই ছিল স্বর্গনদী
দূরের মধ্যে দূরত্ববোধ কে সরাবে**
সনাতন পাঠক, নীল উপাধ্যায়, নীললোহিত ছদ্মনামেও তিনি লিখতেন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা দুশোর ও বেশি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো সেইসময়, পূর্ব পশ্চিম, প্রথম আলো, অরণ্যের দিনরাত্রি, আত্মপ্রকাশ-এর মতো উপন্যাস, হঠাৎ নীরার জন্য, একা এবং কয়েকজন– এর মতো কাব্যগ্ৰন্থ, ছবির দেশে কবিতার দেশে-র মতো ভ্রমণ কাহিনী, কাকাবাবু সন্তুকে নিয়ে অনেকগুলো ছোটদের উপন্যাস, নীললোহিত ছদ্মনামে লেখা বেশ কিছু গল্প এবং উপন্যাস।
***আমার সর্বাঙ্গে কোথাও
একটুও ময়লা নেই
অহঙ্কারের প্রতিভা জ্যোতির্বলয় হয়ে থাকে আমার মাথার পেছনে
আর কেউ দেখুক বা না দেখুক
আমি ঠিক টের পাই
অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়।****(ব্যর্থ প্রেম)
এই মানুষটি সম্পর্কে লিখতে শুরু করলে লেখা আর শেষ হতে চায় না। পাঠকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এই নিবন্ধ লিখিয়ের এমন মোহ কাজ করে এই মানুষটিকে নিয়ে লিখতে গেলে যে মনে হয় আরো আরো আরো লেখা চলতে থাক। পৃথিবীর সব ভাষার সব অক্ষর, শব্দ শেষ হয়ে যাবে তবুও তাঁকে নিয়ে লেখা অসমাপ্ত থেকে যাবে।
****কে না জানে, পাহাড়ের চেয়ে নদীর দামই বেশী।
পাহাড় স্থানু, নদী বহমান।
তবু আমি নদীর বদলে পাহাড়টাই
কিনতাম।
কারণ, আমি ঠকতে চাই****
এমন কবিতা আর কারুর পক্ষে লেখা সম্ভব সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া? তবুও তো শেষ করতে হয়। ২০১২র ২৩শে অক্টোবর তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তাঁর মতো মানুষের কি মৃত্যু হয় কখনো?
***সিংহাসন থেকে একটু নিচে নেমে, পাথরের
সিঁড়ির উপর বসে থাকি
একা, চিবুক নির্ভরশীল
চোখ লোকচক্ষু থেকে দূরে।
‘সম্রাটের চেয়ে কিছু কম সম্রাটত্ব’ থেকে ছুটি নিয়ে আজ
হলুদ দিনাবসানে পরিকীর্ণ শব্দটির মোহে
মাটির মানুষ হতে সাধ হয়***
পাঠকের হৃদয়ে তাঁর চির বাসস্থান। সত্যিই ভালোবাসার হীরের গয়না শরীরে নিয়ে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। তাঁরই কবিতা দিয়ে আজ শ্রদ্ধাঞ্জলী এই আকাশের মতো বিশাল মাপের সাহিত্যিক ও মানুষটিকে....
****আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না মৃত্যু হয় না –
কেননা আমি অন্যরকম ভালোবাসার হীরের গয়না
শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম।****
(জন্ম হয় না মৃত্যু হয় না – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)