২০০২ সালে বাংলার চায়ের দোকানগুলোয় হঠাৎ ঝড় তুলেছিল একটা বাচ্চা ছেলে। তখন বাংলার মাঠে রাজ চালাচ্ছে ইস্টবেঙ্গলের ঘরের ছেলে বাইচুং ভুটিয়া। কিন্তু মোহনবাগান বাগানে যোগ দেওয়া বাচ্চা ছেলেটা তার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে। ছেলেটার নাম সুনীল ছেত্রী। আজ ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা।
ছেত্রী ২০০২ সালে মোহনবাগানে তার পেশাদার কেরিয়ার শুরু করেন। তারপর ২০০৫ সালে জেসিটিতে। ২০০৮ সালে আবার ফিরে আসেন কলকাতার মাঠে। এবার ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে। সেই মরসুমে ১৭ ম্যাচে ৯ গোল করেন তিনি। এরপর কখনও ডেম্পো, কখনও চিরাগ ইউনাইটেড। ২০১০ সালে আমেরিকার কানসাস সিটি উইজার্ডস ক্লাবের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি উপমহাদেশের তৃতীয় খেলোয়াড় যিনি বিদেশে যান।
২০১১ সালে ফিরে আসেন নিজের প্রথম দল মোহনবাগানে। ২০১২-২০১৩ সালে আবার পারি জমান বিদেশে। এবার পর্তুগালের ক্লাব স্পোর্টিং সিপিবিতে। ২০১২ সালেই তিনি প্রথম ভারতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান। পর্তুগাল থেকে ফিরে এসে যোগদেন চার্চিল ব্রাদার্সে সেখান থেকে বেঙ্গালুরু এফসি। এরপর মুম্বাইসিটির হয়ে খেলেন ২০১৫-১৬ সালে। ২০১৬ থেকে বর্তমানে তার দলের ঠিকানা বেঙ্গালুরু।
১৯৮৪ সালের ৩রা আগস্ট সেকেন্দ্রাবাদের এক ফুটবল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সুনীল ছেত্রী। বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্সের অফিসার কেবি ছেত্রী এবং মা সুশীলা ছেত্রী। কেবি ছেত্রী ভারতীয় সেনাবাহিনীর দলের হয়ে ফুটবল খেলতেন। আর মা সুশীলা ছেত্রী এবং তার যমজ বোন খেলতেন নেপাল মহিলা জাতীয় দলের হয়ে।
২০০৪ সালে সুনীল ভারত অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবল দলের হয়ে তার প্রথম খেলা খেলেন। ২০০৪ সালের এপ্রিলে ছেত্রী ভুটান অনূর্ধ্ব-২৩ টিমের বিপক্ষে ২ বার জালে বল জড়ানোয় ৪-১ ব্যবধানে জয় পায় ভারত। ২০০৫ সালের জুন মাসে সুনীল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিনিয়র ভারতীয় জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে তার প্রথম গোল করেন। এই সময় দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সন্তোষ ট্রফির ৫৯তম আসরে সুনীল দিল্লির হয়ে অংশ ছিলেন। গুজরাটের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক সহ সেই টুর্নামেন্টে তিনি ৬ গোল করেছিলেন।
২০০৭, ২০০৯ এবং ২০১২ সালের নেহেরু কাপ এবং সেই সঙ্গে ২০১১, ২০১৫ এবং ২০২১ সালের SAFF চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের জেতায় বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সুনীল ছেত্রী। তার প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ছিল ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া নেহেরু কাপ। উদ্বোধনী খেলায়, ছেত্রীর দুটি গোলে ভারত ৬-০ গোলে কম্বোডিয়াকে পরাজিত করে। তিনি ভারতকে ২০০৮ সালের এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ জিততেও সাহায্য করেছেন, যার ২৭ বছরের মধ্যে দেশকে প্রথম এএফসি এশিয়ান কাপে যোগ্যতা অর্জন করায়। মালয়েশিয়ায় ২০১২সালে অনুষ্ঠিত এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ যোগ্যতার জন্য তাকে জাতীয় দলের অধিনায়ক মনোনীত করা হয়েছিল। এর আগের বছর ২০১১ সালের নভেম্বর মাসের সল্টলেক স্টেডিয়ামে খেলা একটি প্রীতি ম্যাচে মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের হয়ে ৩৯ এবং ৫৩ মিনিটে ২টো গোল করেন সুনীল। ম্যাচটি ৩-২ গোলে ভারতের পক্ষে শেষ হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বর SAFF কাপের ফাইনালে একটি গোল করার পর তিনি SAFF চ্যাম্পিয়নশিপের একক সংস্করণে সাতটি গোল করে ১৯৯৭ সংস্করণে আই এম বিজয়নের ছয় গোলের রেকর্ড ভেঙে এক নতুন রেকর্ড গড়েন। তিনি একরমাত্র প্লেয়ার এখনও যিনি ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টি করে ২০০৭, ২০১১, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৭ এবং ২০১৮-১৯ সালের AIFF প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হন। ছেত্রী তার অসামান্য ক্রীড়া কৃতিত্বের জন্য ২০১১ সালে অর্জুন পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০১৯ সালে তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০২১ সালে, তিনি খেলা রত্ন পুরস্কার পান। ভারতের সর্বোচ্চ ক্রীড়া সম্মান এবং এই পুরস্কার প্রাপ্ত তিনি প্রথম ফুটবলার।
জাতীয় দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড এবং সেরা ফিনিশার ২০১৭ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর তার দীর্ঘদিনের বান্ধবী এবং প্রাক্তন ভারতীয় খেলোয়াড় এবং মোহনবাগানের 'ঘরের ছেলে' সুব্রত ভট্টাচার্যের কন্যা সোনম ভট্টাচার্যকে বিয়ে করেন। ২০১৮ সালের আজকের দিনে সুনীল ছেত্রীকে সালে তার ৩৪ তম জন্মদিনে AFC 'এশিয়ান আইকন' হিসেবে মনোনীত করে।
২০২১ সালে নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে ভারতের অষ্টমবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের নেপথ্যে অন্যতম কারিগর ছিলেন সুনীল ছেত্রী। নেপালের বিরুদ্ধে ফাইনালে গোল করে লিয়োনেল মেসিকেও ছুঁয়েছিলেন তিনি। ট্রফি নিয়ে মলদ্বীপ থেকে সরাসরি দিল্লি গিয়েছিলেন বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সেই সময় ভারতের হয়ে ৮০তম গোল করে মেসিকে ছোঁয়ার পরে নিজের অনুভূতি নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, "দেশের হয়ে সব চেয়ে বেশি গোল করার তালিকায় বিশ্বের সেরা ফুটবলারদের পাশে আমার নাম থাকার অনুভূতিটাই আলাদা। মনে হয় যেন, এটা সব কিছুর চেয়ে আলাদা। একেবারে অন্য পর্যায়ের। তবে আমার প্রবল আপত্তি রয়েছে তুলনায়।" একসময় পিকে, চুনী, বলরাম, জার্নালদের ভারতীয় ফুটবল দল অলেম্পিকে চতুর্থ হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে সুরজিৎ সেনগুপ্ত, সুদীপ চ্যাটার্জি, কৃশানু দের মত আন্তরর্জাতিক মানের ফুটবলার খেলেছেন ভারতীয় দলে। বাইচুং ভুটিয়া প্রথম ফুলবলার যিনি সেই সময়ের জিদান, রোনাল্ডো বা বেকহ্যামদের সাথে মাঠে নেমে ছিলেন। আর এদের সবাইকে টপকে সুনীল ছেত্রীর এখন বিশ্বের সর্ব্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় নাম লিখিয়ে ভারতীয় ফুটবলকে টেনে নিয়ে চলেছেন।
বিশ্বফুটবলে এই মুহূর্তে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের নামের তালিকায় চোখ দিলে দেখতে পাবো প্রথম নাম ক্রিসচিয়ানো রোনাল্ডো, দ্বিতীয় ইরানের আলী দাই, তৃতীয় মালয়েশিয়ার মোক্তার দাহারী, চতুর্থ লিওনেল মেসি এবং পঞ্চম স্থানে যৌথ ভাবে হাঙ্গেরির ফেরেঙ্ক পুস্কাসের সাথে সুনীল ছেত্রী। ভারতের হয়ে ১২৯ ম্যাচে ৮৪ গোল করে ভারতের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনিই।
১৭ বছরের কেরিয়ারে সুনীল ছেত্রী থেকে ফুটবলপ্রেমীদের ‘ছেত্রী’ হয়ে উঠতে অনেক ঘামরক্ত ঝরাতে হয়েছে। মাঠের জীবনকে এমন ক্ষিপ্র রাখতে অজস্র ত্যাগ তাঁর জীবন জুড়ে। ফুটবল তাঁর জীবনের ঈশ্বর। সময় তাই তাঁর কাছে ভীষণ দামী জিনিস। খেলার মাঠে যতটা সময় বাকি আছে সবটুকুকেউ কাজে লাগাতে চান।