শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার পেরিয়ে সিনেমাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন সুমিত্রা দেবী

বাংলা চলচ্চিত্রে গত শতকের চারের দশকে যে ক’জন প্রতিভাময়ী ও অসাধারণ সুন্দরী নায়িকা আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতমা সুমিত্রা দেবী। প্রথম ছবিতেই তিনি অসাধারণ অভিনয় করে দর্শকের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন স্টার। আদায় করে নিয়েছিলেন সেরা অভিনেত্রীর বি এফ জে এ-পুরস্কার। তাঁর সেই প্রথম ছবির নাম, ‘সন্ধি’ (১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। এই সময় সুমিত্রার বয়স ছিল মাত্র একুশ বছর।

সত্যি বলতে কী, ‘সুমিত্রা’ নামে সুমিত্রা দেবী আপামরের কাছে পরিচিত হলেও সেটা তাঁর আসল নাম নয়। অর্থাৎ, পিতৃদত্ত নাম নয়। তাঁর পিতৃদত্ত নাম, ‘নীলিমা’। নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে এই নাম বদল এবং তাঁর অভিনয়ে আসার পেছনে গূঢ় কারণ ছিল।

বীরভূমের সিউড়িতে ১৯২৩ সালের ২২ জুলাই নীলিমার জন্ম হয়েছিল। তাঁদের পরিবারটি ছিল বেশ অভিজাত ও রক্ষণশীল। বাবা ওকালতি করতেন। সেই সময় অনেক বাঙালি অভিজাতেরা ভাগলপুর, মধুপুর, দেওঘরে জমি কিনে বাড়ি বানিয়ে বসবাস করতেন। অথবা ন’মাস ছ’মাস সেই বাড়িতে সপরিবারে গিয়ে কাটাতেন। নীলিমাদেরও সেই রকম একটা ব্যাপার ছিল। ফলে, নীলিমার বাল্য ও কৈশোরের অনেকখানিই সেখানে কেটেছিল। 

ছোট থেকেই নীলিমা ছিলেন সিনেমার একেবারে পোকা। ফি হপ্তায় বাড়ির সকলের সঙ্গে সিনেমা দেখার সুযোগ তিনি পেতেন। তাঁর বালিকা বয়সে সিনেমা কথা বলতে শিখে গিয়েছিল। তাতে গানও যুক্ত হয়েছিল। সব মিলিয়ে মাধ্যমটির গ্ল্যামার বেড়েছিল। আর তাতেই মাধ্যমটির প্রতি নীলিমার আকর্ষণও বেড়েছিল। সেই সময়ের স্টার কাননদেবী, পদ্মাদেবী, উমাশশী হয়ে উঠেছিলেন নীলিমার নয়নের মণি।

আগেই বলেছি যে, নীলিমাদের বাড়িটি ছিল বেশ রক্ষণশীল। ফলে, মেয়েকে বেশিদিন অবিবাহিতা রাখার ঝুঁকি তাঁরা নেননি। নীলিমা যৌবনে পা দেওয়ার মুহূর্তেই ভাগলপুরেরই আর-একটি রক্ষণশীল পরিবারে তাঁরা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু এই বিয়ে নীলিমাকে সুখী করতে পারেনি। রক্ষণশীলতার মোড়কে শ্বশুরবাড়ি দিনের পর দিন সংস্কারের নামে অত্যাচার চালিয়ে গিয়েছিল স্বাধীনচেতা নীলিমার ওপর। দিনের পর দিন সেটা সহ্য করা সম্ভব হল না। বাপের বাড়িতে জানালেন; কিন্তু প্রতিকার হল না। উপায় না-দেখে সুমিত্রা শ্বশুরবাড়ি ছাড়লেন। পালিয়ে এলেন কলকাতায়। আশ্রয় নিলেন বাগবাজারের এক ভাড়া বাড়িতে। যে সিনেমা জগতকে তিনি দূর থেকে ভালবেসেছিলেন, সেই জগতকেই বাঁচার আশ্রয় হিসেবে আঁকড়ে ধরতে সচেষ্ট হলেন।

শোনা যায়, তাঁর এক দাদার সূত্রে যোগাযোগ তৈরি হয়। সুযোগ মেলে দুই জায়গায়। নিউ থিয়েটার্স ও রাধা ফিল্মস-এ। নিউ থিয়েটারর্স-এ তখন হেমচন্দ্র চন্দ্র কে এল সায়গলকে নায়কের চরিত্রে নিয়ে ‘মেরি বহেন’ নামে একটি হিন্দি ছবির পরিকল্পনা করেছেন। খুঁজছেন নতুন ও সুন্দরী অভিনেত্রী। এই সময় সেই দাদাটি তাঁর কাছে নীলিমার একটি ছবি পাঠান। অপূর্ব সুন্দরী নীলিমাকে ছবি দেখে তৎক্ষণাৎ পছন্দ হয়ে যায় পরিচালকের। ডেকে পাঠান স্টুডিওতে। কথা বলে জহুরির মতো বোঝেন, মেয়েটিকে একটু ঘষেমেজে নিলেই প্রতিভার স্ফূরন ঘটবে। ব্যস, ছবিতে কাস্ট করে নেন তক্ষুনি। 

দেওয়ালের চেয়েও বহুগুণ কান থাকে স্টুডিওর বাতাসের। ফলে, খবর পৌঁছে গেল রাধা ফিল্মসের কাছে। রাধা ফিল্মেসের ব্যানারে বিখ্যাত পরিচালক দেবকীকুমার বসু প্রযোজনায় নেমেছেন। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি ঘষেমেজে তিনি চমৎকার একটি স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। সেটি তাঁরই তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করবেন অপূর্ব মিত্র। ছবির নাম, ‘সন্ধি’। গোপনে তিনিও ডেকে পাঠালেন নীলিমাকে। প্রতিভার হিরেকে পরখ করে তিনি নিজে শুরু করলেন ঘষামাজার কাজ। তাঁরই কাছে চলল নীলিমার অভিনয়শিক্ষা। ক্রমে ক্রমে সেই শিক্ষায় নীলিমার অন্তরের সুপ্ত প্রতিভা জেগে হয়ে উঠল যেন শাণিত তরবারি।

‘মেরি বহেন’ ও ‘সন্ধি’ একই সময়ে শ্যুটিং শেষ হলেও ‘সন্ধি’ আগে মুক্তি পেল। ১৯৪৪ সালের ২৬ অক্টোবর ‘মিনার’, ‘বিজলী’ ও ‘ছবিঘর’ প্রেক্ষাগৃহে। ছবির পরিচয়লিপিতে নীলিমা হয়ে উঠলেন ‘সুমিত্রা দেবী’। পুরনো পরিচয় দূরে সরিয়ে রাখতেই নীলিমা এই পরিবর্তনে আগ্রহী হয়েছিলেন। যাই হোক, এই ছবিতে তাঁর অভিনীত চরিত্রটি প্রথম দিকে শান্ত স্বামীর বদমেজাজি স্ত্রী কিন্তু আরশোলাতে ভীতু। ঘটনাক্রমে ধীরে ধীরে স্বামীর মনের মতো হয়ে ওঠাতেই ছবির সমাপ্তি। সুতরাং, নীলিমার অভিনীত চরিত্রটির অনেকগুলো শেড ছিল, সেগুলো তিনি এত সুন্দর ও দক্ষতার সঙ্গে রূপায়ণ করেছিলেন যে, মনেই হয়নি কোন নবাগতা অভিনেত্রী তাতে অভিনয় করেছেন। এই সার্থকতাই নীলিমাকে সাফল্য এনে দিয়েছিল, করে তুলেছিল সবার প্রিয় ‘সুমিত্রা দেবী’।

সুমিত্রা দেবী যখন একের পর এক ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করে রীতিমতো বিখ্যাত, সেই সময় তখনকার আরেক বিখ্যাত অভিনেতা দেবী মুখার্জি একদিন তাঁর মেকআপ রুমে ঢুকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাবনায় এমন একটা দৃঢ়তা ছিল, পৌরুষ ছিল যে; সুমিত্রা তাতে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরও মনের মধ্যে সংসার গড়ে তোলার একটা অতৃপ্ত বাসনাও ছিল। আগের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা একটা দ্বিধাও তৈরি করেছিল। তাই ক’দিন সময় নিয়েছিলেন সুমিত্রা। অবশেষে অনেক দ্বন্দ্ব পেরিয়ে প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিলেন। 

দেবী মুখার্জি ছিলেন অসাধারণ অভিনেতা এবং ভরাট কণ্ঠের অধিকারী। তিনি ‘পথের দাবী’ (১৯৪৭) সিনেমায় সুমিত্রা দেবীর পাশাপাশি ‘সব্যসাচী’ চরিত্রে স্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন; পরবর্তীকালে একই কাহিনি নিয়ে ‘সব্যসাচী’ (১৯৭৭) ছবি নির্মিত হলে এই চরিত্রে উত্তমকুমার অভিনয় করেন। যাই হোক, সুমিত্রা ও দেবী’র বিবাহ হয়েছিল ঠিকই, তাঁরা একটি সন্তানের জন্মও দিয়েছিলেন; কিন্তু বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। কোন এক অজ্ঞাত কারণে দেবী আত্মহত্যা করেন, মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে। এই মৃত্যু সুমিত্রাকে বেশ ধাক্কা দেয়। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে উঠতে কেটে যায় আরও কয়েকটা বছর। অনেক টালমাটাল পেরিয়ে সামান্য সুখের আশায় জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন সুমিত্রা। বিয়ে করেন বোম্বের এক ব্যবসায়ীকে (মিঃ শর্মা)। শুরু করেন সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস।

চার থেকে ছয়ের দশক এই ছিল সুমিত্রার অভিনেত্রীজীবনের সময়কাল। ছয়ের দশক থেকেই তিনি ধীরে ধীরে অভিনয়জীবন থেকে সরে আসতে শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘কিনু গোয়ালার গলি’ তাঁর অভিনীত শেষ বাংলা ছবি। আর হিন্দি ছবিতে তাঁকে শেষ বার দেখা যায় ১৯৭৭ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বোলো হে চক্রধারী’-তে ছোট্ট একটি চরিত্রে। দুই দশকে হিন্দি ও বাংলা মিলিয়ে চল্লিশেরও বেশি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন। ১৯৯০ সালের ২৮ আগস্ট এই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রীর জীবনাবসান হয়।

উল্লেখ্য যে, ১৯৫০ সালে সুমিত্রা অভিনীত ‘মশাল’ ছবিতে গায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মান্না দে। চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকেরা জানেন যে, সুমিত্রা বাংলায় ‘দেবী চৌধুরানী’ (১৯৪৯), ‘সমর’ (১৯৫০), ‘যৌতুক’ (১৯৫৮), ‘অসবর্ণ’ (১৯৫৬); হিন্দিতে ‘উঁচনীচ’ (১৯৪৮), ‘মমতা’ (১৯৫২), ‘জাগতে রহো’ (১৯৫৬) প্রভৃতি ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। কিন্তু হরিদাস ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘আঁধারে আলো’ (১৯৫৭) ছবিতে বাঈজীর ভূমিকায় এবং ১৯৫৬ সালে কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিতে পটেশ্বরী বউঠাকরুনের ভূমিকায় তাঁর অনবদ্য অভিনয় বাঙালি আজও ভুলতে পারেনি। ছায়াছবি যতদিন থাকবে, তাঁর চিত্রিত এই দুই চরিত্র ততদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে; আর বরণীয় হয়ে থাকবে অসাধারণ সৌন্দর্যের সাথে সাথে তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয়।।...         

  

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...