কালি-কলম-মন লেখে তিন জন। বাংলায় এ অতি চলতি প্রবাদ। এবার অতীত ইতিহাসকে নতুন কালির রঙে বেঁধেছে সুলেখা। ২০২৩ আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় বইপ্রেমীদের কাছে আলাদা আবেগ হয়ে উঠেছে সুলেখার মোড়। এতদিন পর্যন্ত এক সুলেখার মোড়কে চিনত বাঙালি, এখন আর এক সুলেখার মোড় হয়ে উঠেছে বাঙালির নতুন টান। সেই মোড় বইপ্রেমি তো বটেই সাধারণ মানুষকেও করে তুলেছে ঐতিহ্য ও ইতিহাসমুখী।
কী আছে সুলেখার মোড়ে?
ধূলোমাখা পথ আর ভিড় সামলে মোড়ে পৌঁছলে দেখা যায় থরে থরে কালি কলম। তাকে ঘিরেই যত আগ্রহ। হারিয়ে যাওয়া ঝর্ণা কলমের খোঁজে সুলেখা কালির প্যাভেলিয়নে এসেছে মানুষ। শুধু কী কলম? আছে কালি আর তার ইতিহাস। ইতিহাসের গায়ে স্বাধীনতার আগুন। ক্ষুদিরাম, গান্ধীজী, রবীন্রনাথের স্মৃতি।
বইমেলায় এই প্রথমবার সুলেখা। ৬ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকলে পৌঁছে যাওয়া যায় প্যাভেলিয়নে। বইমেলা উপলক্ষে এসেছে নতুন সম্ভার ‘সুকান্ত’ কালি। সুকান্ত কালি বাদামি রঙের। আছেন শহীদ ক্ষুদিরাম। কালির নাম স্বাধীন। লাল, কালো, নীল, সবুজ রঙের কালিতে।
সু-লেখা। মানে ভাল লেখা। গান্ধীজী নামকরণ করেছিলেন। অনেকে আবার বলেন এই নামের নেপথ্যে কবিগুরু। রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করেছিলেন কালির। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদায় পাওয়া যায় সুলেখার কথা। ‘জনঅরণ্য’ ছবিতে দেখাও গিয়েছে সুলেখা কালির দোয়াত।
সুলেখার জন্ম স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুনে সময়ে। তখন বিদেশি পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছেন গান্ধীজী। সংস্থার জন্মও আন্দোলনের গর্ভেই। নেপথ্যে এক দামাল স্বাধীনতা যোদ্ধা। প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দী থাকাকালীন পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাশ করেন ননীগোপাল মৈত্র। কারামুক্তির পর ফের ছাত্র হন প্রেসিডেন্সির। তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজে মাস্টার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হোন। পেন্সিল দিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। সাহেবী কলম দিয়ে লিখবেন না, এই ছিল পণ। তাই পরীক্ষায় দ্বিতীয়।
তখন পড়া-লেখার জগতেও ব্রিটিশ কালির আধিপত্য। ১৯৩৪-এ সেই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে নামতেই ভাই শঙ্করাচার্য মৈত্রের সঙ্গে স্বদেশি কালি তৈরির উদ্যোগ নেন। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সুলেখা কালি।
সুলেখা কালির ফর্মুলার ইতিহাসটিও বেশ চমক জাগায়। বিদেশি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। গোরা সাহেবদের পণ্য আগুনে পুড়িয়ে দিকে দিকে বহ্নি উৎসবে মেতে ছিল মানুষ। কিন্তু পড়ালেখার কাছে বিদেশী কালির দাপট। দেশীয় কালি তখনও অধরা। সমাধান খুঁজতে ১৯৩২ সালে গান্ধীজি দেশি কালি তৈরির ভাবনার কথা প্রকাশ করেছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যালসের প্রাক্তন রসায়নবিদ সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তর কাছে। তিনি কৃষ্ণধারা নামে কালি তৈরি করেছিলেন। সেই ফর্মুলাই তিনি দেন রাজশাহী নিবাসী ননীগোপাল মৈত্র আর শঙ্করাচার্য মৈত্রের হাতে।
তিনি দুই তরুণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কালির কার খানা শুরু করার। কিন্তু পুঁজি বড় সঙ্কট। পুত্রদের স্বপ্নকে বাস্তবের রূপ দিতে এগিয়ে আসেন মা সত্যবতী মৈত্র। তিনি নিজেও ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। একসময় রাজশাহী মহিলা সমিতির সভানেত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। মা এবং বাবা অম্বিকাচরণ মৈত্রের সারাজীবনের জমানো পুঁজি দিয়ে ননীগোপাল মৈত্র আর শঙ্করাচার্য মৈত্রের হাতে সূচনা হল ‘সুলেখা’।
১৯৩৪ সালে রাজশাহীতে শুরু হয় 'সুলেখা-ওয়ার্কস'। ১৯৩৬ সালে কলকাতার মহাত্মা গান্ধী রোডে সুলেখার কালির আরও এক শাখা খোলা হয়। ১৯৩৮ সালে সুলেখা কালির একটি নতুন কারাখানা হয় বৌবাজার অঞ্চলে। তারপর ১৯৩৯ সালে কসবা। ১৯৪৬ সালে যাদবপুরে এই কারখানা স্থানান্তরিত হয়।
স্বাধীনতার পর রাজ্য এবং দেশের বাইরেও পৌঁছে যায় সুলেখা। গান্ধীজি থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহেরু, বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখ বিশিষ্টরা ব্যবহার করতেন এই কালি। শোনা যায় প্রতিদিন ভোরে স্নান সেরে লেখার আসনে বসে সাদা কাগজে নীল সুলেখা কালিতে ইষ্টদেবী মা কালীর নাম এক হাজার বার লিখতেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিরিশের থেকে আশির দশক বাংলায় চলেছে সুলেখার সাম্রাজ্য। দেশভাগের পরেই বাংলাদেশে সুলেখা অমিল হয়ে যায়। সুলেখার দীর্ঘ যাত্রাপথে বাধা বিপন্নতা কম আসেনি। ১৯৮৯তে বন্ধ হয়ে যায় সংস্থা। তবে ২০০৬ সালে আবার ফিরে আসে স্বমহিমায়। ২০১১ সাল থেকে শুরু হয় সোলার প্যানেল তৈরি। ২০২০ সাল থেকে শুরু হয় সুলেখা কালির নয়া যাত্রা।
বল পেনের যুগে মানুষকে ফের কালি-কলমে ফিরিয়ে আনার লড়াই সহজ নয়। তবু সংগ্রাম আর লড়ায়ের প্রেক্ষাপটে যার জন্ম তার সে লড়াইয়ে কখনও হার মানে না দেখিয়ে দিল সুলেখা। ২০২৩-এর বইমেলায় সুলেখা মোড়ের ভিড় তার সাক্ষী।