রঙ্গরসিকতার জন্য জোড়া আড্ডাখানা তৈরির করেছিলেন সুকুমার রায়

আদ্যন্ত মজার মানুষ ছিলেন সুকুমার রায়। কেবল লেখায় বা রেখায় নয়, তাঁর গোটা জীবন যেন এক রম্য রচনা। তাই তো আজও তাঁর নামটা শুনলেই বাঙালির মুখে চওড়া হাসি খেলে যায়। পাগলা দাশু, রামগরুড়ের ছানা, ভীষ্মলোচন শর্মা, হুঁকোমুখো হ্যাংলা, কাকেশ্বর কুচকুচের মতো অজস্র চরিত্র সৃষ্টি করে গিয়েছেন সুকুমার। জীবনে দু-খানি ক্লাব গড়েছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পাশ করার পর পরই ১৯০৭ নাগাদ নন সেন্স ক্লাব গড়ে তুলেছিলেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়রা ছিলেন ক্লাবের সভ্য। এই ক্লাবের মুখপাত্র ছিল 'সাড়ে বত্রিশ ভাজা' নামের একটি পত্রিকা। হাতে লেখা এই পত্রিকার জন্যই সুকুমার 'ঝালাপালা' এবং 'লক্ষ্মণের শক্তিশেল' নাটক দুটি লিখেছিলেন। ক্লাবের আসর বসত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর, ২২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে।

এরপর ১৯১১ সালে সুকুমার বিলেত যান। ১৯১৩ নাগাদ দেশে ফেরেন, দু'বছর পর ১৯১৫ সালে আবার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আবার একটি আড্ডাপীঠ গড়ে তোলেন তিনি। ক্লাবের নাম রাখা হয় 'Monday Club', প্রতি সোমবার আড্ডার আসর বসত, তাই একে 'Monday Club' বলেই ডাকা হত। সুকুমার নিজে মজা করে ক্লাবের নাম দিয়েছিলেন 'মন্ডা ক্লাব'। সভ্যদের মধ্যে ছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস নাগ প্রমুখ। ক্লাব তো নয় যেন চাঁদের হাট!

ক্লাবের তৃতীয় বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত একটি গান লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের "আমাদের শান্তিনিকেতন"-এর সুরে গানটি এরকম:

"মন্ডা-সম্মিলন
আমাদের মন্ডা-সম্মিলন।
আরে না – তা' না, না –
আমাদের Monday সম্মিলন।
আমাদের হল্লারই কুপন।
তার উড়ো চিঠির তাড়া
মোদের ঘোরায় পাড়া পাড়া,
কভু পশুশালে হাসপাতালে আজব আমন্ত্রণ।
কভু কলেজ-ঘাটে ধাপার মাঠে ভোজের আকর্ষণ"

সুকুমারের ভাই বোন, আত্মীয়রা এই ক্লাবের সদস্য ছিলেন, সেই সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত মানুষজনও। সুকুমার রায় ছিলেন আড্ডাপ্রিয় মানুষ। তাঁকে ঘিরেই আড্ডাবাজ প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বদের আড্ডা-আসরের বৃত্ত গড়ে উঠেছিল। মন্ডা ক্লাব সম্পাদক, সভাপতিরও পদ থাকত। সুকুমার সেই সব পদ অলংকৃতও করেছেন। মন্ডা ক্লাবে যেমন রঙ্গরসিকতাই চলত, তেমন নানারকম বিষয় যেমন কালিদাসের জিওগ্রাফি, ব্রাহ্মগণ হিন্দু কি-না, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে আলোচনাও চলত। আবার ক্লাবের প্রতিবাদ সভা হত। ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে মন্ডা ক্লাবের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।

ক্লাবের আমন্ত্রণপত্রগুলি ছড়ার আকারে লেখা হত। অন্তমিল যুক্ত মজার ছড়াগুলো লিখতেন ক্লাবের সভ্যরাই। সসুকুমারও এমন ছড়া লিখেছেন।

এক

"সম্পাদক বেয়াকুব
কোথা যে দিয়েছে ডুব-
এদিকেতে হায় হায়
ক্লাবটি তো যায় যায়।
তাই বলি সোমবারে
মদগৃহে গড়পারে
দিলে সবে পদধূলি
ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।
রকমারি পুঁথি কত
নিজ নিজ রুচিমত
আনিবেন সাথে সবে
কিছু কিছু পাঠ হবে
করজোড়ে বারবার
নিবেদিছে সুকুমার।

দুই

শনিবার ১৭ই
সাড়ে পাঁচ বেলা,
গড়পারে হৈ হৈ
সরবতি মেলা।
অতএব ঘড়ি ধরে
সাবকাশ হয়ে
আসিবেন দয়া করে
হাসিমুখে লয়ে।
সরবৎ সদালাপ
সংগীত-ভীতি
ফাঁকি দিলে নাহি মাপ,
জেনে রাখ- ইতি।

তিন

কেউ বলেছে খাবো খাবো,
কেউ বলেছে খাই
সবাই মিলে গোল তুলেছে,
আমি তো আর নাই।
ছোটকু বলে, রইনু চুপে
ক'মাস ধরে কাহিল রূপে!
জংলি বলে 'রামছাগলের
মাংস খেতে চাই'।
যতই বলি 'সবুর কর' -
কেউ শোনে না কালা,
জীবন বলে কোমর বেধে,
কোথায় লুচির থালা?
খোদন বলে রেগেমেগে
ভীষণ রোষে বিষম লেগে –
বিষ্যুতে কাল গড়পারেতে
হাজির যেন পাই।

চার

আমি, অর্থাৎ সেক্রেটারি,
মাসতিনেক কলকেতা ছাড়ি
যেই গিয়েছি অন্য দেশে
অমনি কি সব গেছে ফেঁসে।
বদলে গেছে ক্লাবের হাওয়া,
কাজের মধ্যে কেবল খাওয়া!
চিন্তা নেইক গভীর বিষয়
আমার প্রাণে এসব কি সয়?
এখন থেকে সমঝে রাখ
এ সমস্ত চলবে নাকো,
আমি আবার এইছি ঘুরে
তান ধরেছি সাবেক সুরে।
শুনবে এস সুপ্রবন্ধ
গিরিজার বিবেকানন্দ,
মঙ্গলবার আমার বাসায়।
আর থেক না ভোজের আশায়।

১৯১৯ সাল পর্যন্ত মন্ডা ক্লাব ভালভাবেই চলেছিল। তারপর নানা কারণে এই ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়। ১৯২৩ সালে সুকুমার রায় মারা গেলে ক্লাব পুরোপুরি ভেঙে যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...