শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায়ের প্রথম লেখা বেরিয়েছিল শিবনাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত শিশুদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকা ‘মুকুল’-এ, ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে। সেই প্রথম লেখাটি একটি কবিতা। নাম ‘নদী’।
তখন সুকুমারের বয়স মাত্র আট বছর (জন্ম, ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর)। সেই বয়সেই পয়ার ছন্দে দারুণ দখল ছিল তাঁর। কবিতাটি সেই ছন্দেই লেখা।
সুকুমারের ডাক নাম ছিল ‘তাতা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসটি সুকুমারের জন্মের বছরই গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। তাতে ছিল দুটি শিশু-চরিত্র, ভাই আর বোন। তাদের নাম ছিল 'তাতা' আর 'হাসি'।
নাম দুটো রবীন্দ্রভক্ত উপেন্দ্রকিশোরের খুব মনে ধরেছিল। তাই সাততাড়াতাড়ি পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রথম মেয়ে সুখলতার ডাকনাম পাল্টে রাখলেন ‘হাসি’ আর ছেলে সুকুমারের নাম রাখলেন, ‘তাতা’।
নামসূত্র থেকে শুরু করে সুকুমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রবীন্দ্র সাহচর্য পেয়েছেন। কোথাও কোথাও আবার রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিতও করেছেন। যেমন, উদ্ভট শিশুতোষ ছড়া রচনার ক্ষেত্রে। যদিও দুজনের কবিমন দু’রকমের। তবুও।
আমাদের বাংলা লোকসাহিত্যের ছেলেভুলানো ছড়ায় উদ্ভট-উৎকল্পনার অভাব ছিল না। সেই কবেকার বাংলার মেয়েদের-মায়েদের-ঠাকুমার মুখে মুখে তৈরি ছড়া—
‘ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি
চাম কাটে মজুমদার,
ধেয়ে এল দামোদর
দামোদর ছুতোরের পো
হিঙ্গুল গাছে বেঁধে থো’।
এতে ‘ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি’ জিনিসটা যে ঠিক কী, তা কেউই আমরা জানি না; কিন্তু বলার গুণে অদ্ভুত একটা জীবের ছবি শিশুমনের কল্পনায় ফুটে ওঠে, তারা মজাও পায়। অথচ তার চাম কাটার সঙ্গে মজুমদারের কী সম্পর্ক আর ছুতোরের ছেলেই বা ছুটে এসে কেন তাকে হিঙুল গাছে বাঁধতে বলছে, তা না-বুঝলেও সেই মজার জগতের কিছু যায় আসে না।
তারপরেও ছড়াটার পরের অংশের সঙ্গে এই পাঁচটি লাইনের কোন যোগ নেই। তবু শিশুদের (শুধু শিশুদের কেন, বড়দেরও) বার বার এই ছড়া শুনতে ইচ্ছে করে, ভালো লাগে, একটা উদ্ভট রসে মজে থাকার ইচ্ছে প্রবল হয়।
এই যে গ্রাম্যছড়ার উদ্ভট রস, তার পরিচয় সুকুমারের লেখা ছড়া-কবিতায় আমরা যথেষ্ট পাই। তবে তার কতকটা তিনি স্বদেশি অর্থাৎ লোক-ঐতিহ্য থেকে নিয়েছেন। আর বাকিটা নিয়েছেন বিদেশি ছড়াকার লিয়রের মুন্সিয়ানা থেকে।
তবে ওই দুই ঐতিহ্য মিলেমিশে সুকুমারপ্রতিভায় জারিত হয়ে এক অনন্য ও অননুকরণীয় উদ্ভট জগত তৈরি করেছে। সেই জগতে প্রবেশ করে যে-কেউই পেতে পারেন নির্মল আনন্দ।
কারণ, তা শুধু উদ্ভট রসেই থেমে থাকে না, দেয় অন্যতম অর্থের ইঙ্গিতও। যেমন—
‘আলোয় ঢাকা অন্ধকার
ঘন্টা বাজে গন্ধে তার...’
আপাতপাঠে উদ্ভট মনে হলেও এ-ধরণের পংক্তি সময়ের আঁচড়ে অন্য এক দর্শনের সন্ধান দেয়।
১৯১১ সালে বাবার ছাপাখানার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সুকুমার ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন মুদ্রণশিল্পের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে। ১৯১২-তে সেখানে গিয়ে পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে নিয়ে গেলেন ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ।
তখনও সে-দেশে রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবে ততটা পরিচিত ছিলেন না। সুকুমার ‘দ্য স্পিরিট অব রবীন্দ্রনাথ’ নামের একটি প্রবন্ধ রচনা করে সেখানকার বিখ্যাত ‘কোয়েস্ট’ পত্রিকায় তা প্রকাশের মধ্য দিয়ে শিক্ষিতসমাজের কাছে রবীন্দ্রসাহিত্যকে পরিচিত করানোর একটা প্রচেষ্টা করেছিলেন।
১৯১৩-তে নোবেল জয়ের পর রবীন্দ্রনাথ যখন স্বদেশে ফিরছিলেন, তখন তাঁরই সঙ্গে দেশে ফিরেছিলেন সুকুমার।
এদিকে তিনি দেশে ফেরার মাস চারেক আগে থেকেই উপেন্দ্রকিশোর প্রকাশ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন ছোটদের জন্য মাসিক পত্রিকা, ‘সন্দেশ’। বিলেত থেকে ফিরে সুকুমার তাতেই লিখতে শুরু করলেন উৎকল্পনামূলক ছড়া, গল্প। একের পর এক। তাতে যে 'কুমড়োপটাশ', 'কুঁকড়ো বুড়ো', 'হাঁসজারু' প্রভৃতি উদ্ভট জীবজন্তুজানোয়ারের কথা লিখতেন, সে-সবের মজার মজার স্কেচ তিনিই আঁকতেন।
ফলে, তাঁর উদ্ভটখেয়ালরসে মজে উঠতে সন্দেশের ছোট্ট পাঠকপাঠিকাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত!
আসলে, ছোটরা তাঁর লেখা-আঁকায় খুঁজে পেয়েছিল ঠাকুমার ব্যাঙ্গমাব্যাঙ্গমির তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, রাজপুত্ররাজকন্যার মহল ছাড়িয়ে, জলের নীচের রাক্ষসখোক্কসের দেশ পেরিয়ে আরও একটা জগত। যেখানে—
‘দাড়ি নিয়ে হাঁড়িমুখো কে যেন কে বৃদ্ধ,
রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ।
মাথা নেড়ে গান করে গুন গুন সংগীত—
ভাব দেখে মনে হয় না জানি কি পণ্ডিত!’
কিংবা,
‘(যদি) কুমড়োপটাশ নাচে—
খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে;
চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে;
চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমূলার গাছে!’
আসলে সুকুমার রায়ই প্রথম মানুষ; যিনি সচেতনভাবে ছোটদের জন্য নীতিমূলক ‘পাখি সব করে রব’-এর ‘সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’ জাতীয় কবিতার বাইরে এমন উৎকল্পনাময় ভাবনার বিস্তার ঘটিয়েছেন আমাদের মান্য-বাংলার শিশুসাহিত্যে। আর প্রমাণ করে গেছেন, উৎকল্পনাময় শিশুতোষ ছড়াও প্রতিভার কষ্টিতে ক্লাসিক হয়...