আজ যাকে নিয়ে এই নিবন্ধ তাঁর তুল্য সাহিত্যিক শুধু বাংলায় কেন, সারা পৃথিবীতে আর কেউ জন্মান নি। তিনি অপ্রতীম। তাঁর তুলনা শুধু তিনি নিজেই। মাত্র ছত্রিশ বছরের জীবনে তিনি যে অসাধারণ সাহিত্য কীর্তি সৃষ্টি করে গিয়েছেন তেমনটি সত্যিই বিরল।
পাঠক, আপনার বয়স কতো? কুড়ি, তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট? কিচ্ছু যায় আসে না। মন কোনো কারণে অস্থির? আপনি আজই হাতে তুলে নিন "পাগলা দাশু"...পড়তে শুরু করে দিন। একটা গল্প পড়ে ফেলুন। দেখবেন আর ছাড়তে পারছেন না। পুরো পাগলা দাশু শেষ করার পর আপনার মনেই থাকবে না ঠিক কী কারণে আপনার মন খারাপ হয়েছিল। হাসি ছাড়া যে মানুষ বাঁচতে পারে না এই অনুভব তাঁর লেখা থেকেই তো পাই আমরা।
...ভাবছি মনে হাসছি কেন? থাকব হাসি ত্যাগ করে
ভাবতে গিয়ে ফিকফিকিয়ে ফেলছি হেসে ফ্যাক করে...
শৈশবে আবোলতাবোলে "বাবুরাম সাপুড়ে" অথবা "রামগরুড়ের ছানা" পড়েন নি এমন বাঙালি বোধহয় ভারতে কেন সারা পৃথিবীতেই বিরল। এই লিখিয়ের মনে পড়ে বাংলা বাক্য লিখতে এবং মোটামুটিভাবে পড়তে শেখার পর বছর ছয়েক বয়সে বাবা প্রথম গল্পের বই কিনে দেন। লাল রঙের মলাট। উপরে একটা সবুজ রঙের হাসিমুখে বিড়ালের ছবি। বইটার নাম "সমগ্ৰ শিশু সাহিত্য"...। আস্ত একটা গল্পের বই! পুরোপুরি নিজের! আর পায় কে! শুরু হলো ছড়া মুখস্থ করা। শুরু হলো "আবোলতাবোল"..."আয় রে ভোলা খেয়াল খোলা স্বপনদোলা নাচিয়ে আয় আয়রে পাগল আবোলতাবোল মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়"..."শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে"..."বাপ রে কি ডানপিটে ছেলে কোনদিন ফাঁসি যাবে নয় যাবে জেলে"..."ভয় পেয়ো না ভয় পেয়ো না তোমায় আমি মারবো না"...অথবা "খাই খাই"..."খাই খাই করো কেন এসো বসো আহারে"...সত্যি কথা বলতে কি এই ছড়াগুলো যে বাঙালি শৈশবে পড়েন নি তাঁর সত্যিকারের ছোটবেলা বলে কিছু নেই। একটু বড়ো হওয়ার পর "হযবরল", দ্রিঘাংচু, হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরী, ঝালাপালা, শব্দকল্পদ্রুম, লক্ষণের শক্তিশেল, অবাক জলপান...আরো আরো কতো...
১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ৩০শে অক্টোবর জন্ম হয় এই ক্ষণজন্মা সাহিত্যিকের। বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী...মা বিধুমুখী দেবী যিনি সমাজ সংস্কারক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির প্রথমা কন্যা। এমন মা বাবার সন্তান সুকুমার যে অসাধারণই হবেন সে আর নতুন কী? প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি দুটো বিষয়েই বি. এসসি (অনার্স) পাশ করে তিনি লন্ডনে প্রিন্টিং টেকনোলজি পড়তে চলে যান। ১৯১৩তে দেশে ফিরে এসে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সম্পাদিত "সন্দেশ" পত্রিকায় যোগ দেন। সন্দেশে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতা "খিচুড়ি"...
"হাঁস ছিল সজারু (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল হাঁসজারু কেমনে তা জানি না"..
প্রসঙ্গতঃ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তাঁর অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন সুকুমার রায়। রবীন্দ্রনাথ রচিত "বিসর্জন" নাটকে একটি বালকের নাম ছিল তাতা। সেখান থেকেই সুকুমারের ডাকনাম রাখা হয়েছিল "তাতা"..
উপেন্দ্রকিশোর মারা যাওয়ার পর সন্দেশ পত্রিকার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেন সুকুমার। টানা আটবছর অর্থাৎ আমৃত্যু তিনি এই কার্যভার চালিয়ে গিয়েছিলেন। সন্দেশেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা অসাধারণ সব ছড়া, কবিতা, গল্প এবং নাটক। ছোটবেলায় "অবাক জলপান" নাটকে অভিনয় করে নি এমন বাঙালি আছে নাকি! সত্যি বলতে কি সন্দেশ পত্রিকাকে তিনি একটি আন্তর্জাতিক মানের শিশু পত্রিকা করে তুলেছিলেন। কে লেখে নি সন্দেশে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, কামিনী রায়, সুখলতা রাও থেকে লীলা মজুমদার.. বিখ্যাত সব সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেশ পত্রিকায়।
এই সন্দেশেই "জীবনী" নাম দিয়ে একটি সিরিজ লিখেছিলেন সুকুমার। এই সিরিজে খুব সহজ সরল ভাষায় বিশ্ববিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন ডেভিড লিভিংস্টোন, সক্রেটিস, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, গ্যালিলিও, আর্কিমিডিস, জোয়ান অফ আর্ক, কলম্বাস এবং লুই পাস্তুরের মতো মহান মানুষদের সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম।
শুধু লেখাই নয়, অসাধারণ ছবি ও আঁকতেন তিনি। আর তাঁর ফুলের মতো সুন্দর মনেরও পরিচয় পাই আমরা...পুণ্যলতা চক্রবর্তী... সুকুমার রায়ের বোন এবং বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক...লিখেছেন তিনি...
..."দাদার প্রধান ঝোঁক ছিল মজার ছবির উপর। দাদার বই খাতা কত মজার মজার ছবিতে ভরা থাকত, পড়ার বইয়ের সাদা-কালো ছবিগুলি সব রঙিন হয়ে যেত। একবার আমরা তিনজনে টবে ফুলগাছ লাগালাম। দিদি আর সুরমামাসির গাছে কি সুন্দর নীল রঙের ফুল ফুটল, আর আমার গাছে সাদা কুঁড়ি ধরল দেখে আমার ভারি দুঃখ হল। পরদিন সকালে উঠে দেখি, আমার গাছে ওদের চেয়েও সুন্দর নানা রঙের ফুল ফুটেছে। আমার তো আনন্দ ধরে না। অনেকক্ষণ পড়ে মেজেতে রঙের ছিটে দেখে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম যে, এগুলো আসলে রঙিন ফুল নয়, কোন ভোরে উঠে দাদা রঙ তুলি নিয়ে আমার সাদা ফুলগুলোকে রাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছে।"...
১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দের আজকের দিনে অর্থাৎ ১০ই সেপ্টেম্বর এই অপ্রতীম ছন্দ-কারিগর, ভারতীয় সাহিত্যে প্রথম "ননসেন্স রাইম" এর প্রবর্তক সুকুমার রায় কালাজ্বরে ভুগে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছিলেন। একমাত্র সন্তান সত্যজিৎ তখন আড়াই বছরের। তিনি যখন মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। সুকুমার কবির গান শুনতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রোগশয্যার পাশে থেকে গেয়েছিলেন "আছে দুঃখ আছে মৃত্যু"...
মৃত্যুর কয়েক দিন আগে সুকুমার রায় লিখেছেন...
"ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর
গানের পালা সাঙ্গ মোর"...
সুকুমার রায় চলে যাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে একটি প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন যেখানে আচার্যের ভাষণে তিনি বলেন
..."আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো অল্পকালের আয়ু নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে আর কাউকে দেখি নি।" ...
তথ্যসূত্র: ছেলেবেলার দিনগুলি...পুণ্যলতা চক্রবর্তী।।