দাদু উপেন্দ্রকিশোর মারা গিয়েছিলেন জন্মের ছ'বছর আগে, বাবা সুকুমার মারা গেলেন জন্মের দু'বছর পর। ফলে, এঁদের কাউকেই সত্যজিৎ তেমন করে পাননি, আর-পাঁচটা ছেলে যেমন করে দাদুকে পায়, বাবাকে পায়। এঁদের দু'জনের সঙ্গেই তাঁর চেনাশোনা বড় হতে হতে রঙে রেখায় আর লেখায়।
ঠাকুরবাড়িতে যেমন ওবিন ঠাকুর ছবি লিখতে শিখেছিলেন, তেমনি রায়বাড়িতে সত্যজিৎ লিখতে শিখলেন সেলুলয়েড। সেই শিক্ষা কিছু এসেছিল রক্তসূত্রে, আর কিছুটা বাড়ির সাংস্কৃতিক আবহ থেকে। ঠাকুরবাড়ির মতোই রায়বাড়ির এক বিশাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
শৈশবে রবীন্দ্রনাথ বাবা ও মায়ের স্নেহের ছায়া থেকে নেহাতই বঞ্চিত হয়েছিলেন, পারিবারিক ফালতু নিয়মে। কৈশোরে সে অভাব কিছুটা পুষিয়ে নেবার সুযোগ রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণের সময় থেকেই বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল তাঁর।
কিন্তু, বাবাকে সেভাবে পাবার সুযোগ সত্যজিৎ পাননি। দু'বছর বয়সের স্মৃতি হারিয়ে ফেলে সত্তা। বাবা তখন কালজ্বরে অসুস্থ। তখন এ-রোগের কোন চিকিৎসা ছিল না। তার ওপর রোগ ধরাও পড়ল অনেক দেরিতে।
তবু সুকুমারকে সুস্থ করে তুলতে স্ত্রী সুপ্রভার সেবার কোন ত্রুটি ছিল না। তাঁর অক্লান্ত সেবায় সুকুমার কখনো খানিক সুস্থবোধ করেন, কখনো আবার খুব অসুস্থ। তারই মাঝে তাঁর লেখালেখি চলে আর চলে প্রিয় পুত্রসন্তান মানিককে সময় দেওয়া।
সময় দেওয়া মানে, কোলে নেওয়া, কান্নাকাটি করলে ভোলানো, ঘুম পেলে ঘুমপাড়ানি গানে দোলানো। আর এ-সব করতে করতেই চলে তাঁর স্বরচিত হিজিবিজি কতরকমের ননসেন্স ছড়াকাটা। শুধু তো ছড়াকাটা নয়, সেই সঙ্গে চলে ছন্দে তাল দিয়ে ছেলের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে কখনো-সখনো নেচে ওঠাও :
"ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর-গেলা কোৎকারে,
অন্ধ বনের গন্ধগোকুল ওরে আমার হোৎকারে..."
বাবার অমনধারা ছেলেমানুষি দেখে খিল খিল করে হেসে উঠতেন ছোট্ট মানিক, সত্যজিৎ। সেই হাসি যেন আর থামতেই চাইত না। তিনি চাইতেনও না এ-আমোদ এত তাড়াতাড়ি শেষ হোক। তাঁর আধো অস্ফুট ভাষায় হয়তো আব্দার ধরতেন, আলো আলো আলো...। সন্তানের আব্দার মেটাতে বাবারও উৎসাহের অন্ত থাকত না যেন। অন্তহীন বাৎসল্যে ভুলেই যেতেন শরীর তাঁর শক্ত নয়, সুস্থ নয়।
সুকুমারের মৃত্যুর অল্প কিছুকাল আগে ডাক্তারের পরামর্শে তাঁরা হাওয়া বদল করতে সোদপুরে বাসা নিয়েছিলেন। গঙ্গার ধারে। বাসা থেকে বড় জানলা বেয়ে স্পষ্ট দেখা যেত গঙ্গা। সেই জানালার পাশে একটা আরাম কেদারায় সুকুমার শুয়ে থাকতেন সারাদিন।
সেখানে শুয়েই কখনো লিখতেন, কখনো ছবি আঁকতেন। মানিক তাঁর পাশটিতে নীচে বসে খেলা করতেন। টুকরো টুকরো অবসরে সুকুমার তাঁর গল্পে গল্পে মন ভোলাতেন। আর নতুন জগৎটাকে চিনিয়ে দেওয়ার মতো কিছু চোখে পড়লে আঙুল তুলে তুলে দেখিয়ে দিতেন। এমনি করে একদিন স্টিমারের ভোঁ-বাঁশি শুনে তাঁকে স্টিমার দেখালেন। চিনিয়ে দিয়েছিলেন লৌকিক জলযান। কিন্তু তাই দেখে মানিকের মনে হয়েছিল যেন অলৌকিক। তিনি যে কী খুশি হয়েছিলেন! তাঁর সেই সর্বব্যাপ্ত খুশি দেখে তৃপ্ত সুকুমার সেদিন আসন্ন মৃত্যুর কথাও ভুলে গিয়েছিলেন।
এসব মানিকের মনে থাকার কথা নয়। মনেও ছিল না। তাই পরবর্তীকালে 'সুকুমার সাহিত্য সমগ্র' সম্পাদনা করতে গিয়ে ভূমিকায় লিখেছিলেন, "আত্মীয়তা সূত্রে একজন মানুষের সঙ্গে আরেক জনের যে পরিচয় হয়, আমার সঙ্গে আমার বাবার সেরকম পরিচয় হবার কোন সুযোগ হয়নি।"
বাবাকে তিনি চিনেছিলেন রেখায়, লেখায় এবং মা ও আত্মীয়দের মুখে শুনে। সেভাবেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর অসাধারণ প্রতিভাবান পিতাকে। সৃষ্টির পথ ধরেই পিতা তাঁর চিরসঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন।
সেই সঙ্গসূত্র ধরেই 'সুকুমার রায়' তথ্যচিত্র ছাড়াও তাঁর পূর্ণদৈঘ্যের কাহিনিচিত্রে বার বার এসেছে বাবার রচনার অনুষঙ্গ। যেমন :
'সোনার কেল্লা' ছবিতে জটায়ুর প্রথম আবির্ভাবে ফেলুদার সঙ্গে আলাপ পর্বে ফেলুদা যখন ছাতি, কোমর, কব্জি সবেতেই ছাব্বিশ ইঞ্চি বলে; তখন জটায়ু ফস করে বলে বসেন, 'আপনি কি শুয়োর!' তখন 'হ য ব র ল'-র উইট স্মরণ করে ফেলুদা, তপসে ও জটায়ুর সঙ্গে আমরাও হেসে ফেলি। যিনি এর সঙ্গে 'হ য ব র ল'-কে রিলেট করতে পারবেন না, তিনি এখানে পরিবেশিত শুদ্ধ ও নির্মল রসটি পাবেন না। 'হ য ব র ল'-তে রয়েছে :
'বুড়ো...হুঁকোটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর পকেট থেকে কয়েকখানা রঙিন কাঁচ বের করে তাই দিয়ে আমায় বার বার দেখতে লাগল। তারপর কোত্থেকে একটা পুরনো দরজির ফিতে এনে সে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, "খাড়াই ছাব্বিশ ইঞ্চি, হাতা ছাব্বিশ ইঞ্চি, আস্তিন ছাব্বিশ ইঞ্চি, ছাতি ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলা ছাব্বিশ ইঞ্চি।"
আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, "এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি শুওর?"....।'
এছাড়াও 'পরশ পাথর' ছবিতে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া ভারতবর্ষের অন্তঃসারশূন্য স্বপ্ন ও বেকারত্বের ইতিহাস সত্যজিৎ সুকুমার রায়ের 'দ্রিঘাংচু' গল্পের একটি ছড়ার মোক্ষম ব্যবহারে ফুটিয়ে তুলেছেন :
"হলদে সবুজ ওরাং-ওটাং,
ইটপাটকেল চিৎপটাং
মুশকিল আসান কুঁড়ে মালি
ধর্মতলা কর্মখালি।"
এভাবেই বারে বারে সৃষ্টিসূত্রে স্রষ্টা পিতাকে তিনি আবিষ্কার করেছেন, পিতাপুত্রের মধ্যিখানের অদৃশ্য সুতোটিকে দৃশ্যমান করেছেন। প্রমাণ করেছেন, পিতার শিশুপাঠ্য রচনামালা শিশুপাঠ পেরিয়েও অনেক গভীরে আঘাত হানতে চায়; যেমন তাঁর 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' বা 'হীরক রাজার দেশে' শিশু চলচ্চিত্রের পথ অতিক্রম করে অনেক প্রতিবাদের কথা বলে যায়, তেমনি করে। এভাবেই প্রত্যক্ষত তেমন করে না-পেয়েও অনুধ্যানে-অনুভবে ও ঐতিহ্যে সত্যজিৎ পিতাকে গভীরভাবে পেয়েছিলেন, সেটা অনুধাবন করা যায়...