চৌরঙ্গী রোডে জাদুঘরের পাশের সোজা রাস্তা ধরে এগোলে একটা রাস্তার মুখে এসে দাঁড়াতে হয়। আপাত চোখে দেখলে সেরকম কোনও বিশেষত্ব নেই এই রাস্তার। কিন্তু এই রাস্তাই কলকাতার বর্ণময় চরিত্রে যোগ করেছে আলাদা মাত্রা। রাস্তার নাম ‘সদর স্ট্রিট’।
সদর স্ট্রিট কলকাতার আর পাঁচটা গলি বা লেনের থেকে একেবারেই আলাদা। কলকাতার পুরনো গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছে ওল্ড লন্ডন। শুধু ব্রিটিশ সংস্কৃতি নয় তার সঙ্গে বাকি বিশ্বও।
নিউ মার্কেট থেকে সোজা ফায়ার ব্রিগেডের দিকে হেঁটে গেলে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট। তার জংশন থেকে শুরু হয় সদর স্ট্রিট পাড়া।
সদর স্ট্রিটের আগে নাম ছিল ফোর্ড স্ট্রিট। কী থেকে নাম বদলালো তার কোনও সঠিক তথ্য সেভাবে না পাওয়া গেলেও মনে করা হয় উইলিয়ম ফোর্ডের নাম অনুযায়ী আগে এই রাস্তার নাম ছিল ফোর্ড স্ট্রিট। তার কাছেই ছিল সদর কোর্ট। পরে লোকের মুখে মুখে এই রাস্তার নাম হয়ে যায় সদর স্ট্রিট।
কলকাতার এই রাস্তাতেই সস্তায় থাকার জন্য হোটেল লজ খোঁজে বিদেশি ছাত্ররা। কলকাতায় আসা বিদেশি পর্যটকদেরও প্রথম পছন্দ সদর স্ট্রিট। ষাটের দশকে সদর স্ট্রিট হিপিদের ডেন হয়ে ওঠে। নিউমার্কেটের বিলিতি এসেন্স তো ছিলই তার সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল নিও-আমেরিকান সংস্কৃতি।
১০ নম্বর সদর স্ট্রিটের একটি বাড়ি কিছুদিনের জন্য ভাড়া নিয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। মহর্ষির সেজছেলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সস্ত্রীক থাকতেন এই বাড়িটিকে। বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যেত ফ্রি স্কুল স্ট্রিট্রের বাগান। জ্যোতি ঠাকুর এবং তাঁর স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বাড়িতে বসেই তিনি লিখেছিলেন নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ। প্রভাতসঙ্গীত কাব্য গ্রন্থের অন্তর্গত। সেই বাড়িটি অবশ্য এখন আর নেই। তার জায়গায় হয়েছে শপিং সেন্টার।
সদর স্ট্রিট ধরে এগোলে পরপর ট্রাভেল এজেন্ট আর মানি এক্সচেঞ্জ কিয়স্কো। বিরিয়ানি হালিমের দোকান আর নিখাদ বাঙালি রেস্তোরাঁ। বাংলাদেশি পর্যটকদের আধ্যিকের জন্য সদর স্ট্রিটকে ঢাকা শহর ভেবে নেওয়াও আশ্চর্য কিছু নয়।
ফুটপাতে কাশ্মীরি শালের দোকান। বিদেশী রেকর্ডের দোকানগুলো আজও চোখ টেনে নেয়। ঝিমিয়ে থাকা পেপার স্টলে পুরনো ম্যাগাজিন। ট্রেন্ডি জামাকাপড়, জাঙ্ক জুয়েলারী, ঝোলা এ পাড়ার হিপি কালচারকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। দরদাম করতে জানলে খুব একটা লোকসান হয় না।
সদর স্ট্রিট লাগোয়া রেস্তরাঁ এমন কী ফুটপাতের চাইয়ের দোকানের লোকটাও বিশুদ্ধ ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে কথা বলে উঠতে পারে আপনার সঙ্গে।
রাস্তার ধারের চায়ের দোকানেও মিলবে অ্যামেরিক্যানো, এক্সপ্রেসো, ক্যাপুচিনো। কেরোসিনের স্টোভে মোচা কফি, হানি লেমন টি। এমন রঙিন চরিত্র কলকাতার আর কোনও রাস্তায় পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে।
কিড স্ট্রিট আর সদর স্ট্রিটের জংশনে অ্যাস্টোরিয়া হোটেল। আগে ব্রিটিশ মেনু সার্ভ করা হত। সদর স্ট্রিটের অন্যতম ‘ডেস্টিনেশন’ ফেয়ারলন হোটেল।
রোজি সার্কিজ এবং তাঁর স্বামীর হাতে উইলিয়ম ফোর্ডের ভিলাতেই গড়ে ওঠে ফেয়ারলন হোটেল।
গ্রাফিটি সদর স্ট্রিটের অন্যতম আকর্ষণ। পুরনো বাড়ির রংচটা দেওয়াল, অন্ধকার গলি সেজে উঠেছে বিদেশি শিল্পীর তুলির টানে। সেখানে উঠে এসেছে ভারতবর্ষ আর মানুষের ছবি।
সদর স্ট্রিট শুধুমাত্র একটা রাস্তা নয়। এ আসলে কলকাতার মধ্যেই এক অন্য পৃথিবীর খোঁজ। শুধু চোখে দেখা নয়, তাঁকে আবিষ্কার করতে হয় অনুভূতি দিয়ে।