পঞ্চাশ ষাটের দশকে অনেক বাঙালির বিশ্বাস ছিল তিনি স্বর্গের অলকাপুরী থেকে নেমে আসা কোনও দেবীর বাঙালি ‘ভার্সান’। যাঁকে দূর থেকে চোখে দেখা যায়। মুগ্ধ হওয়া যায় কিন্তু ‘টাচ’ করা যায় না। খানিকটা মাটির রং মেশা কল্পনার মতো। শুধু অনুভবে যাঁর বাস।
বাঁকা গ্রীবা, ভাসা চোখ, তির্যক দৃষ্টি, আর চিবুকের তিল দিয়ে উদ্ধত অহংকার আর চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী যে ‘অ্যাপিল’ তৈরি করে ছিলেন তাঁকে এড়িয়ে যাওয়া আজও দুঃসাধ্য।
তিনি সুচিত্রা সেন। বাঙালির চিরন্তন বিদ্যুৎলতা।
জন্ম বাংলাদেশের পাবনা জেলায়। ১৯৩১ সালে। নাম রমা দাশগুপ্ত।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর কলকাতায় চলে আসেন সপরিবারে।
টালিগঞ্জের রূপালী দুনিয়ায় তাঁর এসে পড়া যেন অনেকটা নিয়তি নির্দিষ্ট পথেই।
বালিগঞ্জের বনেদি অভিজাত পরিবারের দিবানাথ সেনের বিয়ে সম্পন্ন হয় বেশ ছোটবেলাতেই। কিন্তু অভিনয়ের বীজ মনের মধ্যে কোথাও যেন জল-বাতাস পাচ্ছিল নিয়মিত নিয়মে।
তাই ধরা দিল দিবানাথ সেনের চোখে। তিনিই স্ত্রী রমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন বিখ্যাত পরিচালক বিমল করের কাছে। ঘটনাচক্রে তাঁর বোন ছিলেন আদিনাথ সেনের প্রথমা স্ত্রী।
বিমল কর তাঁর সঙ্গে পরিচালক সুকুমার দাশগুপ্তের আলাপ করিয়ে দেন। সেই সময় সুকুমার দাশগুপ্ত তাঁর ছবির জন্য নতুন মুখ খুঁজছেন। একেবারে আনকোরা রমা সেনের স্ক্রিন টেস্ট নেওয়া হল। অভিনেত্রী হিসেবে চূড়ান্ত হলেন তিনি। ছবির নাম ‘সাত নম্বর কয়েদী’।
সুকুমার দাশগুপ্তের সহ-পরিচালক নবাগতা নায়িকার নতুন নামকরন করলেন। রমা সেন হলেন ‘সুচিত্রা’। সুচিত্রা সেন। সেই নামেই নাম সই করলেন ছবির চুক্তিপত্রে।
১৯৫৪ সালে পর পর ৯টা ছবিতে সই করলেন সুচিত্রা সেন। কাজরী, সাড়ে চুয়াত্তর, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য এর মতো ছবিও ছিল সেই তালিকায়।
পরের বছর জন্ম হয় দিবানাথ আর রমার কন্যা মুনমুনের। ফিল্মি কেরিয়ার আর মাতৃত্বের মধ্যে ভারসম্য বজায় রাখার লড়াইটা শুরু থেকেই ছিল।
‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’ আর ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তাঁর কেরিয়ারের। তারপর থেকে ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে রমা দাশগুপ্তের জীবন। ‘সুচিত্রা সেন’ হয়ে ওঠার জার্নি শুরু।
বাকি দু’দশক বাংলা সিনেমা শাসন করেছেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন ‘দ্য ডিভা’।সৌন্দর্য, গ্ল্যামার বাদ দিয়েও শুরু থেকেই তিনি আত্ম সচেতন। টানটান ঋজু ব্যক্তিত্ব। সেটাই তাঁকে আলাদা করে তুলেছিল বাকিদের থেকে।
উত্তম-সুচিত্রা না সুচিত্রা-উত্তম
উত্তম সুচিত্রা না সুচিত্রা উত্তম এই নিয়ে বাঙালির ঝগড়া আজও শেষ হয় না। কিন্তু বাংলা সিনেমায় তাঁদের মতো বানিজ্য সফল জুটি আর আসেনি। সুচিত্রা সেনের সফল ৬০ টি সিনেমার মধ্যে ৩০ টিই পর্দায় তাঁর সঙ্গে দেখা গিয়েছিল উত্তম কুমারকে।
এই জুটি অভিনীত ‘সপ্তপদী’, ‘শিল্পী’, ‘হার মানা হার’, ‘ ইন্দ্রানী’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘শাপমোচন’, ‘সূর্যতোরণ’ বাঙালির কাছে চিরন্তন হয়ে আছে। তাঁরা শুধু অভিনেতা- অভিনেত্রী হয়ে থাকেননি, হয়ে উঠেছিলেন ‘ফিনোমেনন’।
বাংলা সিনেমার রোম্যান্টিক যুগ পরিনতি পেয়েছিল সুচিত্রা সেনের মধ্যে দিয়ে।