কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর গান সম্পর্কে বলেছিলেন, 'স্বরলিপিসুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের গান যদি শুধু পুঁথিবদ্ধ হয়ে থাকত, যদি তা সুবিনয় রায়দের মতো গায়কদের গলায় ধ্বনিত না হত, তা হলে আমাদের জীবনের অনেকটাই কি শূন্য হয়ে যেত না? রবি ঠাকুরের যোগ্য বাহন হওয়া কি কম ভাগ্যের কথা?'
হ্যাঁ! সত্যিই তাই, রবীন্দ্রনাথের গান আর তাঁর কণ্ঠ যেন একে অপরের জন্যই তৈরি হয়েছিল। কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ পাড়ায় এক ব্রাহ্ম পরিবারে ১৯২১ সালের ৮ নভেম্বর সুবিনয় রায়ের জন্ম হয়েছিল। তাঁর বাবা বিমলাংশুপ্রকাশ রায় ছিলেন রসায়নবিদ, আবার সেই সঙ্গে প্রখ্যাত সাহিত্যিকও। সুবিনয় রায়ের বড় হওয়া রবীন্দ্র ঘরানার মধ্যেই, তাঁর মা সুখময়ী ভাল গান গাইতেন, অনবদ্য এস্রাজ বাজাতেন। কিছু দিন শান্তিনিকেতনের মেয়েদের হস্টেল শ্রীভবনের হস্টেল সুপার হিসেবে কাজ করছিলেন।
সুবিনয়ের বড় মাসি সুধাময়ী ছিলেন রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী। তাঁরা শান্তিনিকেতনেই থাকতেন। স্বাভাবিক ভাবেই সুবিনয়ের ছেলেবেলার বড় অংশ জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসঙ্গীত। মা সুখময়ী দেবীই ছিলেন সুবিনয়ের অনুপ্রেরণা। ছোটবেলায় অবশ্য নিজে গাইতেন না, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের ভাই প্রফুল্লের বাঁশির সুরের নেশায় তখন তিনি মুগ্ধ।
সুবিনয়ের মাকে গান শেখাচ্ছেন সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়, পাশের ঘরে বসে বাঁশিতে সেই সুর তুলে নিচ্ছেন ছোট্ট সুবিনয়। হঠাৎ সুরেনবাবুর কানে পৌঁছল বাঁশির সুর। ডাক পড়ল সুবিনয়ের। তখনই তাঁকে একটা অংশ গেয়ে তুলে দিলেন। এই শুরু হল গানের যাত্রাপথ। সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ দেখে, বাবা মা সুবিনয়কে শান্তিনিকেতনের শিক্ষাভবনে আইএসসি পড়তে পাঠালেন। ১৯৩৭-৩৮ সাল, সুবিনয় যে গান গাইতেও পারে, তা আবিষ্কার করলেন রসায়নের শিক্ষক শৈলজারঞ্জন মজুমদার।
তিনি আবার সঙ্গীত ভবনে গানও শেখাতেন। স্বয়ং রবি ঠাকুর মজা করে তাঁকে ‘কেমিক্যাল মিউজিশিয়ান’ বা ‘মিউজিক্যাল কেমিস্ট’ বলে ডাকতেন। গান আর কেমিস্ট্রি দুটোতেই সুবিনয়ের গুরু হলেন শৈলজারঞ্জন। তবে শ্রোতারা সুবিনয় রায়ের কণ্ঠে রাগাশ্রয়ী রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে বেশি পছন্দ করতেন। ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণীই তাঁকে প্রথম এই রাগরাগিণীমূলক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বলেছিলেন। সুবিনয় রায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন।
একদিন শৈলজারঞ্জন তাঁকে বললেন, 'তুমি তো ভালই গানটান করো। ‘বর্ষামঙ্গল’ অনুষ্ঠান হবে। সেখানকার রিহার্সালে তুমি ঢুকে পড়ো। গুরুদেব নিজে গান শেখাবেন উত্তরায়ণের ‘শ্যামলী’ আর ‘পুনশ্চ’য়।' সেখানেই সুবিনয় রায় প্রথমবারের মতো সামনে থেকে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সেই সময় ১৬টি গান শিখিয়েছিলেন। এরপর ১৯৩৯ সালে বিএসসি পড়তে সুবিনয় কলকাতা এসে সিটি কলেজে ভর্তি হলেন। ১৯৪১ সালে সিটি কলেজে অঙ্কের ক্লাস করতে করতে খবর এল, রবীন্দ্রনাথ চলে গিয়েছেন।
সে দিন সুবিনয়ও কাতারে কাতারে মানুষের সঙ্গে কলকাতার রাজপথে হেঁটেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে, তাঁর গানকে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে শৈলজারঞ্জনের অনুরোধে এবং শুভ গুহঠাকুরতা ও সুজিতরঞ্জন রায়ের উদ্যোগে ৮ ডিসেম্বর ১৯৪১, ভবানীপুরের একটি ভাড়াবাড়িতে প্রতিষ্ঠা হয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার স্কুল গীতবিতান। এটি ছিল শান্তিনিকেতনের বাইরে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্কুল।
অনাদি দস্তিদারের অনুরোধেই উত্তর কলকাতায় সুবিনয় রায়ের ১ ভুবন সরকার লেনের বাড়িতে এই প্রতিষ্ঠানের একটি শাখা খোলা হয়। সুবিনয়ই এই শাখাটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণীর ডাক পেয়ে সঙ্গীতভবনেও শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি। ১৯৪৫ সালে কাজের খোঁজে সুবিনয় শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। কর্মজীবনের পাশাপাশি সঙ্গীত শিক্ষার পরবর্তী পর্যায়েরও শুরু হয়। শুধু গান গাওয়া নয়, রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মার্থকে উপলব্ধি ও আত্মস্থ করতে শুরু করলেন তিনি। পাশাপাশি গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখতে শুরু করেন সুবিনয়। গান শুনেই গিরিজাশঙ্কর বুঝে ফেলেন সুবিনয় আগে থেকেই গান জানেন।
তাই প্রতি বৃহস্পতিবার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ক্লাস শুরুর আগে সুবিনয়কে দুটি রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে শোনাতে হত গুরুকে। চোখ বন্ধ করে সেই গান শুনে, তার পর ক্লাস শুরু করতেন গিরিজাশঙ্কর। কলকাতার রেডিও স্টেশনের অডিশনে প্রথম চেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হন। এবারেও সুবিনয়কে বাঁচালেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে একটি রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে বলা হয়েছিল।
সুবিনয় গাইলেন ‘ওগো তুমি পঞ্চদশী’ এবং অডিশনে উত্তীর্ণ হলেন। যদিও আকাশবাণী তাঁকে এরও অনেক পরে ডেকেছিল। অনাদিকুমার দস্তিদারের পরিচালনায় কলম্বিয়া কোম্পানি থেকে ১৯৪৫ সালে সুবিনয়ের প্রথম রেকর্ড বেরোয়। তিনি গেয়েছিলেন দুটি গান, ‘এই করেছ ভালো’ ও ‘তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে’, দুটোই রবীন্দ্রনাথের। পরের বছর ১৯৪৬-এ দ্বিতীয় রেকর্ড বেরোয় ‘এলেম নতুন দেশে’ ও ‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’।
সুবিনয় রায় কেবলমাত্র একজন সুগায়ক ছিলেন না, ছিলেন এক দক্ষ শিক্ষক। এই দ্বৈত পরিচয়ই তাঁকে সমসাময়িক গায়কদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। স্বতন্ত্র এক গায়কি ছিল তাঁর।
সেই সময়ে ছিল পঙ্কজ মল্লিকের দাপটের যুগ! রেডিও এবং চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গায়ক ৪১ বছরের পঙ্কজ মল্লিক নিভৃতে ২৫ বছর বয়সের এক তরুণের কাছে রবীন্দ্রনাথের গানের তালিম নিতে আসতেন। সুবিনয় নিজেই জানিয়েছেন এ কথা, যদিও অনেকেই সন্দিহান ছিল। ডাক্তার শিবপদ ভট্টাচার্যের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে প্রতি রবিবার পঙ্কজবাবু আসতেন, সুবিনয়ের কাছে গান শিখতেন। দুটো হারমোনিয়াম রাখা থাকত। শোনা যায় পঙ্কজ মল্লিক তাঁকে অধ্যাপক বলে ডাকতেন।
তাঁর প্রশিক্ষণেই ‘তিমির অবগুণ্ঠনে’, ‘খরবায়ু বয় বেগে’, ‘আঁধার অম্বরে’ আর ‘নাই নাই ভয়’ রেকর্ড করেছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। গানগুলিও তাঁর বেছে দেওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা, রেকর্ডে ট্রেনার হিসেবে সুবিনয় রায়ের নাম ছিল না। চল্লিশের দশক জুড়ে সুবিনয় রায় নিজেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবেই তুলে ধরেছিলেন। শান্তিনিকেতনের ‘সংগীত ভবন’, কলকাতার ‘গীতবিতান’, ‘দক্ষিণী’, ‘গীতবীথি’ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে তিনি গান শিখিয়েছেন।
পরবর্তীকালে রানি মহলানবীশের উদ্যোগে আইএসআইতে যে গানের স্কুল খোলা হয়েছিল, সেখানে এবং পরে ছাত্র সন্তোষ ঠাকুরের স্কুল 'গান্ধর্বী'-তেও তিনি শিক্ষকতা করেছিলেন। তাঁর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। সুবিনয় রায় নিজেও গানের শিক্ষক পরিচয়ে বেশি খুশি হতেন। কোনওদিনই তিনি জনপ্রিয় গায়কের ভূমিকায় এসে দাঁড়াতে চাননি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের শ্রোতারা ১৯৭২ সালে স্টুডেন্টস হেলথ হোমের অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রথম গায়ক হিসেবে পান।
এরপর থেকে নিয়মিত তিনি জনসমক্ষে গান গেয়েছেন। ১৯৪৬-এর পর ১৯৬১-তে তিনি আবার রেকর্ডের জন্য গান গেয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনের পর রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে তৈরি হওয়া বিপুল আগ্রহই তাঁকে বাধ্য করেছিল তাঁর ভাবনাকে লিপিবদ্ধ করতে। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর অসামান্য বই ‘রবীন্দ্রসংগীত সাধনা’। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এবং সেই সঙ্গে পৃথিবীর বহু দেশে রবীন্দ্রনাথের গানকে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। গেয়েছেন, রবীন্দ্র বিষয়ক বক্তৃতাও দিয়েছেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীতে অনন্য অবদানের জন্য ‘রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি’ পুরস্কার, দক্ষিণীর ‘শুভ গুহঠাকুরতা পুরস্কার’, কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি ও বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ সন্মান পেয়েছেন সুবিনয়। তাঁর রেকর্ড ও ক্যাসেটের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। তাঁর দিনযাপনের সঙ্গে মিশে ছিল রবি ঠাকুর। বড় ছেলে সুরজিতের অকালপ্রয়াণের পরেও তাঁর আশ্রয় ছিলেন রবি ঠাকুর।
মৃত সন্তানের দেহের সামনে দাঁড়িয়েও রবীন্দ্রনাথের গানের শুচিতাকে নষ্ট হতে দেননি। 'কত অজানারে' গানের স্কেল কেঁপে যাওয়ায় ‘জানি তুমি মঙ্গলময়’ গানটি গাইলেন। সামনে শুয়ে রয়েছে মৃত ছেলে; গানের শেষ বলেছিলেন, ‘রাণা শান্তি পেল’। এমনই ছিল তাঁর রবীন্দ্র চর্চা। কয়েক কোটি মানুষ রবীন্দ্রনাথের গানকে উপজীব্য করে জীবনধারণ করছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে, রবীন্দ্র দর্শনের সঙ্গে দিনযাপন করেছেন কেবল একজনই। কারণ সবাই সুবিনয় রায় হন না।