সরস্বতী পুজো ও সুভাষচন্দ্র

সরস্বতী বৈদিক দেবী, সরস্বতী পুজোর দিন থেকে চৌষট্টি কলা শিক্ষার শুরু হয়। এককালে টোল পাঠশালায় পটে দেবীর পুজোর প্রচলন হয়েছিল। সেখান থেকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাবু সম্প্রদায়ের হাত ধরেই জাঁকজমকপূর্ণ সরস্বতী পুজোর প্রচলন হয়েছে। সরস্বতী পুজো মানেই বাঙালির ১৩ পার্বণের অন্যতম এক বড় পার্বণ। বিশেষ করে স্কুল-কলেজে এবং পড়ুয়াদের কাছে দিনটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যার দেবীর পুজো। শহর কলকাতার অনেক ছাত্রাবাসেই তখন ঘটা করে পালিত হয় সরস্বতী পুজো।
 
সময়টা ১৯২৮ সাল, তখন সরস্বতী পুজো মানে একান্তভাবেই বাগদেবীর আরাধনা। নিছক একটি সরস্বতী পুজোর পরিকল্পনাকে ঘিরেই সমস্যার সূত্রপাত হল আর তার মধ্যেই বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্রসহ বাংলার অসংখ্য প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব।
 
রামমোহন হোস্টেলের হিন্দু ছাত্ররাও ঠিক করলেন, তারা সরস্বতী পুজো করবেন। পুজোর প্রস্তুতি শুরু হল। এর মাঝেই গোল বাঁধল কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।
 
ব্রাহ্ম সমাজের আনন্দমোহন বসুর হাতে সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠা। ব্রাহ্ম মতাদর্শে প্রতিষ্ঠিত হলেও সব ধর্মের ছাত্রদের জন্যই পঠনপাঠন চলত কলেজে। কিন্তু কলেজ ও ছাত্রাবাসের জীবনধারার মধ্যে একটা ব্রাহ্ম প্রভাব ছিলই। ফলে সেখানে মূর্তিপূজা নিয়ে আপত্তি জানালেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। অধ্যক্ষ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র সরাসরি ছাত্রদের সংযত হতে বললেন। কিন্তু তাতে লাভ হল না। কারণ হিন্দু ছাত্রদের দাবির সপক্ষে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তখন তিনিই বাংলার তরুণ-তুর্কী নেতা। সুভাষ জানিয়ে দিলেন, সরস্বতী পুজো হবে।
 
আসলে সরস্বতী পুজো নিয়ে একধরণের দুর্বলতা সুভাষচন্দ্রের মধ্যে বরাবরই ছিল। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান হলেও তাঁর লেখনিতে সরস্বতী পুজোর কথা বারবার উঠে এসেছে। বাল্মিকী প্রতিভার শেষ দৃশ্য তো সরস্বতী বন্দনা। কিন্তু সিটি কলেজের সরস্বতী পুজো বিতর্কে রবীন্দ্রনাথকে একেবারেই ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে দেখা গেল। 'দ্য সরস্বতী পূজা ইন দ্য সিটি কলেজ হোস্টেল' শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি লিখলেন, "সিটি কলেজ ব্রাহ্মদের, এবং ব্রাহ্মরা প্রতিমাপূজক নহেন, এ-কথা প্রত্যেক ছাত্রই জানেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার ৫০ বৎসর পরে হঠাৎ সেখানে প্রতিমা পূজা করার জন্য জিদ অশোভন।" অন্যদিকে সুভাষচন্দ্রও উত্তর দিতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার। কলেজের কর্তৃপক্ষ কখনই নিজেদের ধর্মবিশ্বাস ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। অ্যালবার্ট হলের সভায় তিনি সরাসরি বললেন, "আলোকপ্রাপ্ত এবং অগ্রসর ব্রাহ্ম ভদ্রলোকেরা হিন্দু ছাত্রদের উপর নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এত নিচে কী করে নামলেন, আমি তা অনুধাবন করতে অক্ষম।"
 
সিটি কলেজের সরস্বতী পুজোকে ঘিরে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হল দুই কিংবদন্তির মধ্যে, অচিরেই তা সাধারণ বাঙালির মনেও ছড়িয়ে পড়েছিল। অবশেষে যদিও রামমোহন ছাত্রাবাসে সরস্বতী পুজো মুলতুবি রইল। কিন্তু পুজোর আয়োজন করার জন্য ৪ ছাত্রকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিলেন হেরম্বচন্দ্র মৈত্র। দেখতে দেখতে সমস্ত হিন্দু ছাত্র সিটি কলেজ ছেড়ে দিতে লাগল।
 
স্বাভাবিকভাবেই কলেজের অর্থভাণ্ডারে টান পড়ল। আর এই সমস্যার শিকার হলেন কবি জীবনানন্দ এবং আরও কিছু অস্থায়ী শিক্ষক। জীবনান্দ নিজেও অবশ্য ব্রাহ্ম আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু শোনা যায় ছাত্রাবাসের হিন্দু ছাত্রদের নিজস্ব ধর্মাচরণে বাধা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না তিনি। রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছিলেন, "তাহলে তো মুসলমান ছাত্রদের কুরবানি করিবার অধিকারও দিতে হয়।" হ্যাঁ, সেটাও দিতেই চেয়েছিলেন জীবনানন্দ। কিন্তু অর্থাভাবে জীবনানন্দের চাকরি চলে গিয়েছিল।
 
সরস্বতী পুজোর প্রতি সুভাষচন্দ্রের বরাবরের দুর্বলতা ছিল। মুর্শিদাবাদ আর সুভাষচন্দ্রকে মিলিয়ে দিয়েছে সরস্বতী পুজো। জীবনে দশ-বারোবার সুভাষ মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলেন। ১৯১৩-১৪ সাল নাগাদ মুর্শিদাবদে সুভাষচন্দ্র প্রথম এসেছিলে সম্ভবত ১৬-১৭ বয়সে ছাত্রাবস্থায়।
 
সুভাষের বাল্যবন্ধু, কৃষ্ণনগরের হেমন্ত সরকার লিখেছেন, ''কৃষ্ণনগর থকে ট্রেনে আমরা পলাশি গেলাম।...যুদ্ধক্ষেত্রে ভ্রমণ করতে করতে আমি কবি নবীনচন্দ্র সেনের 'পলাশীর যুদ্ধ' আবৃত্তি করলাম। সেই আবৃত্তি শুনে সূভাষচন্দ্র চোখের জল ফেললেন।'' পলাশি ভ্রমণের পরে সুভাষকে নিয়ে কয়েক বন্ধু যান বহরমপুরে হেমন্তকুমারের আত্মীয়ের বাড়ি়। পরদিন লালবাগ গিয়ে নবাব সিরাজের সমাধিক্ষেত্র দেখতে যান সুভাষ। ভাগীরথী সান্নিধ্যে আবৃত্তি করেন, 
 
''এই গঙ্গায় ডুবিয়াছি হায় ভারতের দিবাকর হে
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার হে।''
বহরমপুর ছাড়াও বেশ কয়েক বার নানা কর্মসূচিতে জঙ্গিপুর, রঘুনাথগঞ্জ, জিয়াগঞ্জ লালবাগ, বেলডাঙা, কান্দি, লালগোলা, গোকর্ণ, জেমো, পাঁচথুপি গিয়েছেন সুভাষ। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অর্থ তহবিল সংগ্রহের জন্য বহরমরপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে এসে বক্তৃতাও করে গিয়েছেন সুভাষচন্দ্র। ​সুভাষচন্দ্র বহরমপুরে এলে হয় শশাঙ্কশেখর বা মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ব্রজভূষণ গুপ্তের বাড়িতে উঠতেন। বলাইবাহুল্য, মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র বসু এসেছেন বেশ কয়েক বার।
 
যেমন সভা করতে এসেছেন; তেমন জেল খাটতেও এসেছেন। ১৯২৩ সালে সুভাষকে বন্দি করে ব্রিটিশ পুলিশ। পরের বছর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বহরমপুর জেলের সাত নম্বর ঘরে। এখন সেটি হয়েছে মানসিক হাসপাতাল। ​বহরমপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে সেই ঘরে ইতিহাস কিন্তু আজও বেঁচে আছে।জেলের ভিতরেই সরস্বতী পুজো করার জন্য জেদ ধরেন সুভাষ।
 
প্রথমে না করলেও, সুভাষচন্দ্রের জেদের কাছে মাথা নুইয়ে জেল কর্তৃপক্ষ অবশেষে সুভাষের পুজো করার দাবি মেনে পুজোর ব্যবস্থা করেন। শোনা যায়, পুজো দেখতে যাওয়ার অছিলায় অনেকেই সুযোগের সদব্যবহার করে, জেলের ভিতরে সুভাষের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ সুদে-আসলে মিটিয়েছিলেন। সে সময়ে বহরমপুরের নামী চিকিৎসক সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বছর বারোর মেয়ে উষা জেলের পুজো দেখার জন্য জেদ ধরেন।
 
ডাক্তারবাবু আর কী করেন, মেয়েকে নিয়ে যান জেলখানায়। এই উষাই হলেন আইনজীবী তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম, পরে সাংসদ শশাঙ্কশেখর সান্যালের স্ত্রী। শশাঙ্কশেখর ও উষাদেবীর লেখা অনুসারে, সেটি সরস্বতী পুজো ছিল না, ছিল দুর্গাপুজো। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর 'সমকালীন ভারতে সুভাষচন্দ্র' গ্রন্থ এবং বহরমপুর জেল থেকে দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে লেখা সুভাষের চিঠি কিন্তু অন্য কথা বলে।
 
লোকসংস্কৃতি গবেষক পুলকেন্দু সিংহ 'মুর্শিদাবাদে সুভাষচন্দ্র' গ্রন্থে লেখেন, ''বহরমপুর জেল থেকে সুভাষচন্দ্র ৮।১২।১৯২৪ তারিখে শরৎচন্দ্র বসুকে লিখেছেন, 'গত বুধবার আমি এখানে এসে পৌঁছেছি।' অর্থাৎ তিনি বহরমপুরে এসেছিলেন ৩।১২।১৯২৪ তারিখে। এখান থেকে তিনি যান ২৫।১।১৯২৫ তারিখে। তখন দুর্গাপুজোর সময় নয়। সময়টি ছিল সরস্বতী পুজোর।'' বলাইবাহুল্য দুর্গাপুজো হয় শরৎকালে, আর সুভাষচন্দ্র মুর্শিদাবাদে ছিলেন শীতকালে, জানুয়ারির শেষে বা ফেব্রুয়ারীর শুরুতে সরস্বতী পুজো হয়। অতএব ঐ সময় সরস্বতী পুজোই করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। আজও সেখানে ​সরস্বতী পুজো হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...