কলকাতা শহর ফনির অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে চপ আর মুড়ি সহযোগে একটা সুন্দর বর্ষার বিকেল কাটিয়ে ফেলেছে। ফনী এলো না বলে আমাদের অনেকে অভিমান করে অনেক কষ্ট পেয়ে পরের দিনের গরমে আবার বেরিয়ে গেছি। বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসেনি আমাদের জীবনে। হতাশায় দু-লাইন চুটকি বলেছি নেহাত।
কলকাতা শহর অভিমানে রয়েছিল বটে কিন্তু অন্যদিকে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে একটা গোটা জায়গা। এই ভয়ংকর দুর্যোগে পরিবর্তন হয়েছে অনেকের জীবন। হারিয়ে গেছে পরিবার, পরিজন, বন্ধু। মৃত্যু হয়েছে অনেকের। পরিবার হারা, পরিজন হারা বাচ্চারা নিষ্পলক চোখ নিয়ে তাকিয়ে বিধাতার দিকে - 'আশায়', যেন সে চোখ মেলে দেখে।
"ফণীর জন্য পাশের রাজ্য ওড়িশা এবং পাশের দেশ বাংলাদেশ এর সাধারণ মানুষ যে অবস্থায় পড়েছেন, সেই সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো সমাজের মানুষ হিসেবে কর্তব্য।"
এই বলে শুরু করেছিল তারা। এই "তাঁরা" দের নাম নেই, ধর্ম নেই আছে শুধু এক পরিচয় তারা 'ছাত্র'। পাশের রাজ্যের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে আমরা সাধারণেরা ভুলে থাকলেও, ছাত্ররা ভোলে নি। মানুষ হিসেবে এই ধরণের একটা কাজ করাকে তারা তাদের দায়িত্ব বলে মনে করে। কত মানুষ যারা ওখানে রয়েছে তাদের মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির বর্ণনা। কিছু মানুষ আছে যারা এই পরিস্থিতিকে সামলাতে লড়ছে দৌড়াচ্ছে।
ফোনের এপারে বসে প্রশ্নগুলো বললাম বটে। অনেক কথার মাঝে একটি কথা মনে গেঁথে গেল।
'তোদের মধ্যে কাদের নাম দেব?'
'না, নাম কারোর দিস না। শুধু ছাত্র-ছাত্রী বলিস'
তাই বলছি এই 'তাঁরাদের' খুব দরকার আমাদের সমাজে। যাদের নাম নেই। যাদের মধ্যে কিছু একটা করার ইচ্ছা আছে, ইচ্ছা আছে অনেক কিছু বদলানোর।
সাহায্য করার জন্য তারা নেমেছে রাস্তায়, পিচবোর্ডের বাক্স নিয়ে ঘুরেছে অলিগলি। ছুটেছে বিভিন্ন জায়গায়, ছাত্র থেকে আরেক ছাত্রের কাছে। যাদবপুর ৮ বি, যাদবপুর স্টেশন, সন্ধ্যা বাজার এলাকা দিয়ে তারা প্রথম শুরু করে তারপর ঝড়ের মত এই দৌড় চলে। কলেজ স্ট্রিট, শ্রীরামপুর চত্বর, গড়িয়াহাট, চন্দননগর পর্যন্ত তারা ঘুরতে থাকে। এই কথাগুলি নিয়ে ভাবা, লেখা যতটা সোজা কাজটা করাটা ততটা নয়। মানুষ হিসেবে দায়িত্ব আমাদের অনেক কিন্তু সেটা পালন করেছে এই ছাত্র-ছাত্রীর দল।
'পৌঁছে যাবে মানুষের কাছে'
ফোনের ওপার থেকে শুনতে পেলাম ' আজ রাতেই তিনজনের টিম বেরোচ্ছে'
তিনজন কাল রাতে বেরিয়ে গেছে ওড়িশার দিকে, তারা চলে যাবে ভুবনেশ্বর। চলে যাবে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে, যেই গ্রামগুলো একেবারে ভেসে গেছে। তারা দেখে আসবে সেই পরিস্থিতি এবং সেই অনুযায়ী সাহায্য নিয়ে আরো টিম যাবে। প্রত্যেকটি মানুষের কাছে তারা যাবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ সব নির্বিশেষে তারা চলে যাবে মানুষের কাছে। একটা রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে প্রত্যেক পরিবার হারা মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে সাহায্য।
আশা রাখি এই ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে মানুষ যেন বেরিয়ে আসতে পারে, আশা রাখি এইভাবে এখনও মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়ানোর মত মানুষ যেন চিরকাল থাকে। চিরকালের যুব সমাজ যেন এইরকমটাই থাকে। এইরকম ভাবেই ছড়িয়ে পড়ুক তারা মানুষের মধ্যে, রাস্তার ফুটপাত থেকে পৌঁছে যেতে হবে গ্রামে, গভীর জঙ্গলে বন্যা কাটিয়ে সভ্যতা আবার তৈরী করতে হবে।
আপাতত তাঁরা প্রায় ৫০ থেকে ৬০,০০০ টাকা জোগাড় করে ফেলেছে। এখনো অনেক কলেজে গিয়ে টাকা তোলা বাকি। থেমে থাকবেনা তারা। তাঁদের স্বপ্ন লাখের দিকে। তারা আরো আরো স্বপ্ন দেখুক। দৌড়ে যাক তাদের স্বপ্ন, ভাবনা দূর অনেক দূর।
ওড়িশা এবং পাশের দেশ বাংলাদেশ যেন এই ভয়ঙ্কর ঘটনা কাটিয়ে উঠতে পারে। আবার শুরু করতে পারে জীবন নতুন করে।যারা চলে গেছে তাদের ভোলা যাবে না। তাদের না ভুলেই আবার নতুন করেই শুরু করা যাক সব কিছু। আশা রাখি।