স্ট্রবেরি অত্যন্ত লোভনীয় একটি ফল। সরস এবং সুগন্ধী এই ফল দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি রয়েছে তার দারুণ সব পুষ্টিগুণও। ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ফসফরাস, ফাইবার, প্রোটিন প্রভৃতি প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ যথেষ্ট পরিমাণে এই ফলে রয়েছে। তাই এর দামও বেশ ভালো থাকে বাজারে। এখানেই একটা ব্যাপার আমাদের ভাবতে হবে যে, বাজারে যে ফল বিক্রি হয়, তা উৎপাদিত হয় ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। ফলে, তাতে যথেষ্ট রাসায়নিক সার যেমন প্রয়োগ করা হয়; তেমনি কীটনাশকেরও প্রয়োগ হয় যথেচ্ছ। আবার বাজারে আনার পরও তাকে সতেজ রাখতে ও সংরক্ষিত করে রাখতে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়। এসবের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার মতো পরিকাঠামো আমাদের নেই। তাই এই সমস্যা থেকে বাঁচতে যে ফলগুলো স্বল্প পরিসরে ফলানো যায়, সেগুলো সামান্য আয়াসে ফলিয়ে নেওয়াই ভালো। কারও যদি একফালি ছাদ থাকে, কিংবা থাকে ছোট্ট ব্যালকনি; আর তাতে আসে ঘণ্টা পাঁচেকের শীতের রোদ; তাহলে তিনি অনায়াসেই স্ট্রবেরি চাষ করতে পারবেন। কোন সমস্যা হবে না।
স্ট্রবেরি একটি শীতকালীন ফল। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই ফল ফলে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের শীতের মরসুমে এই ফল জৈব উপায়ে অনায়াসে ফলানো যায়। স্ট্রবেরি গাছের খুব বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। টবে বা মাটির সরায় কিংবা পলিব্যাগে এই গাছ খুব সুন্দরভাবে চাষ করা যায়। এই গাছের মূল আসলে গুচ্ছমূল; মাটির খুব একটা গভীরে যায় না। তাই স্ট্রবেরি চাষ করতে খুব বেশি গভীর পাত্রের প্রয়োজন নেই। চার, ছয় বা আট ইঞ্চির টব বা সমমাপের নিকাশি সুবিধেযুক্ত পাত্র ও পলিব্যাগ এই চাষের জন্য আদর্শ।
স্ট্রবেরি চাষ করার জন্য প্রথমে যেটা লাগবে, সেটা হচ্ছে একটা বেশ সবুজ ও স্বাস্থ্যবান চারা। জেনে রাখা ভালো, সমস্ত মরসুমজুড়ে আপনি এক একটা গাছ থেকে চারশো গ্রাম থেকে পাঁচশো গ্রাম ফল পাবেন। এবার আপনার প্রয়োজন ও বাগানের জায়গা কতটা আছে; সেই হিসেবে পরিমাণমতো চারা কিনে আনবেন। বিভিন্ন বাজারে চারার বিভিন্নরকম দাম; তিন-চার ইঞ্চির পটশুদ্ধু চারা কমবেশি তিরিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা করে পাওয়া যায়। অনলাইনে বীজ কিনতে পাওয়া যায়; চারাও পাওয়া যায়; কিন্তু তাতে দাম অনেক বেশি পড়ে যায়। আমার মতে, বীজ কেনার থেকে স্থানীয় বাজার বা নার্সারি থেকে চারা কেনাই ভালো।
স্ট্রবেরি রোদ বেশি চায়; জলও বেশি চায়। স্টবেরির টবের মাটি সবসময় আধভেজা থাকলে খুবই ভালো। কিন্তু টবে যেন কিছুতেই জল একটুও না-জমে থাকে বা জল যাতে দাঁড়িয়ে না-থাকে—এটা সবসময় খেয়াল রাখতে হবে। জল জমে থাকলেই গোড়া পচবে, গাছ মরবে; তখন কিচ্ছু করার থাকবে না।
অনেকেই এই জল নিকাশের সুবিধের জন্য টবে শুধু কোকোপিট দিয়ে স্ট্রবেরি চাষ করেন। অনেকেই আবার দু’ভাগ মাটির সঙ্গে দু’ভাগ কোকোপিট মিশিয়ে মাটি তৈরি করে তাতে স্ট্রবেরি চাষ করেন। যারা জানেন না, তাঁদের জন্য বলি, নারকেলের ছিবড়ের গুঁড়ো হল কোকোপিট। এটা নার্সারি বা অনলাইনে থান-ইটের আকারে জমাটবাঁধা অবস্থায় কিনতে পাওয়া যায়। সেটা সহজেই ভাঙা যায় এবং ভেঙে ভেঙে ব্যবহার করা যায়। কোকোপিট একটুও জল জমতে দেয় না টবে, বাড়তি জল টবের ফুটো দিয়ে বের করে দিয়ে নিজে ভেজা ভেজা হয়ে থেকে গাছকে সতেজ হয়ে বাড়তে সাহায্য করে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কোকোপিট ব্যবহার করি না। আমি এক ভাগ এঁটেলমাটি, এক ভাগ ভার্মি কম্পোস্ট আর দু’ভাগ বালি একসঙ্গে মিশিয়ে স্ট্রবেরির জন্য মাটি তৈরি করি। টবের তলার ফুটোতে খোলামকুচি দিয়ে ঢেকে তার ওপর বালি ও কুচো পাথরের একটা ইঞ্চি-তিনেকের লেয়ার তৈরি করে তার ওপর তৈরি করা মাটি দিয়ে টবের আশি ভাগ ভর্তি করি। নিয়মিত জল দেওয়ার জন্য, পরবর্তীতে খোল-সার দেওয়ার জন্য, প্রয়োজনে গাছের গোড়ায় সামান্য মাটি দেওয়ার জন্য টবের ওপরের কুড়ি ভাগ অংশ ফাঁকা রাখি।
যাই হোক, চারা বসানোর জন্য টবের মাটির ওপর ঠিক মধ্যিখানে পাঁচটা আঙুল একসঙ্গে চেপে ছোট্ট একটু গর্ত করে নিতে হবে। যে-কোন কোম্পানির ফাঙ্গিসাইড বা ছত্রাকনাশক এক চিমটে তাতে দিতে হবে; পরিবর্তে আধমুঠো হলুদগুঁড়ো দিলেও হবে। সাধারনত নতুন লাগানো চারার শেকড় ছত্রাকের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গাছের মৃত্যু ডেকে আনে। হলুদগুঁড়ো বা রাসায়নিক ফাঙ্গিসাইড সেই সমস্যার প্রতিকার করে। তাই এগুলোর যে-কোন একটি দিয়ে সেই গর্তে চারাটি বসিয়ে চারার চারপাশ ভালো করে মাটি বা কোকোপিট দিয়ে চেপে দিতে হবে। তারপর জল দিয়ে টবের মাটি ভিজিয়ে গাছশুদ্ধ টবটি তিন দিন ছায়ায় রেখে দিতে হবে। এ-ক’দিনেই চারাটি রোপণের ধকল সামলে নেয়; নতুন মাটির দিকে শেকড় ছড়ানোর জন্য চেষ্টা শুরু করে দেয়। ফলে, চারদিনের দিন রোদযুক্ত স্থানে টবশুদ্ধ চারাটি এনে বসানো যায়।
চারা বসানোর দিনসাতেকের মধ্যেই দেখবেন, গাছ মাটি ধরে নিয়ে আকারে-প্রকারে বাড়তে থাকবে, ঝাড় কাটতে থাকবে। বেশ ঝোপালো হয়ে উঠবে। যখনই মনে হবে জল পেতে পেতে ওপরের মাটি বেশ চেপে বসেছে টবের ওপর, তখনই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে আলগা করে দেবেন। আলগা মাটিতে বাতাস চলে ভালো, তাতে গাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। টবের জলনিকাশী ব্যবস্থাও ভালো থাকে। চারা বসানোর সাতদিন পর থেকে শুরু হবে এই পরিচর্যা। মনে রাখবেন, গাছের গোড়ায় জল একদম জমতে দেবেন না, আগাছা একদম হতে দেবেন না। এই সময় থেকেই সপ্তাহে এক বার করে গাছের গোড়ায় সরষের খোল পচানো জল দেবেন। শুকনো খোল জলে ভিজিয়ে তিনদিন ধরে পচিয়ে তারপর ছাকনিতে ছেঁকে যে জলটা পাওয়া যাবে, সেটাতে আরও জল মিশিয়ে পাতলা করে তারপর গাছের গোড়ায় দিতে হবে। মনে রাখবেন, খুব বেশি হলে চার থেকে পাঁচ দিনের পচানো খোলজল এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। তার চেয়ে বেশিদিনের পচানো খোলের জল একদম গাছের গোড়ায় দেবেন না, সেটা গাছের জন্য ক্ষতিকর ছত্রাকের জন্ম দেয়। এছাড়াও পেঁয়াজ, রসুন ও সব্জির খোসা একটা পাত্রে জল দিয়ে মুখ ঢেকে পনের দিন ধরে পচিয়ে সেই জল ছাঁকনিতে ছেঁকে আরও জল মিশিয়ে পাতলা করে সপ্তাহে একবার গাছের গোড়ায় দিতে হবে। এক সপ্তাহে খোলপচা জল দিলেন, তো অন্য সপ্তাহে খোসাপচা জল দিলেন—এভাবে উল্টেপাল্টে পুষ্টিযুক্ত খাবার দেওয়ার কাজটা চালিয়ে যেতে হবে। আসলে, মানুষের মতো গাছেরও এক খাবার নাগাড়ে দিলে রুচি নষ্ট হয়, গ্রহণ করতে চায় না তেমন; সেজন্যই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দুটো খাবার দিতে হয়। যাই হোক, এর বেশি যত্নের প্রয়োজন হয় না স্ট্রবেরিতে। এতেই দেখবেন রঙে-রূপে স্ট্রবেরি গাছ চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে, মন ভরিয়ে দিচ্ছে আপনার।
তাহলে আর কী, এই বর্ষা থেকেই স্ট্রবেরি চারা লাগানোর কাজ শুরু করে দিন। পরেও লাগাতে পারেন। তবে, অক্টোবরের মধ্যেই লাগানো শেষ করতে পারলে ভালো। তাতে নভেম্ভরের শেষ থেকে ফুলের দেখা পাবেন, পাবেন ফলের দেখাও। এই সময় গাছের পাতার ফাঁক থেকে লম্বা লম্বা ডাঁটি বেরোবে। তারই আগায় সাদা সাদা ফুল ফুটবে। ফল ধরবে। ঝুলে থাকবে টবের চারপাশের কিনার বেয়ে। ফলের রঙ প্রথমে সবুজ-সাদা থাকবে। পেকে গেলেই একেবারে লালে লা হয়ে উঠবে। হয়ে উঠবে তুলতুলে নরম। তখন আর কী, টুক করে তুলে টুপ করে মুখে ভরে দিলেই হল, টক-মিষ্টি রসে অমৃতের স্বাদে ভরে উঠবে মন। একে নিজের ফলানো, তায় নির্বিষ ফল—সুতরাং, তার মাহাত্ম্যই আলাদা!
স্ট্রবেরি চাষে সবচেয়ে বড় কথা হল, এতে চারার জন্য একবার ইনভেস্ট করলেই হয়। পরে আর কিনতে হয় না। একটা গাছ থেকে খান বিশেক চারা অনায়াসেই পাওয়া যায় (যারা বিশেষভাবে যত্ন করতে পারেন, এক গাছ থেকেই তাঁরা সত্তর থেকে শতখানেক চারা তৈরি করে নেন।)। কিন্তু সেই চারা কীভাবে পাওয়া যায়? বলছিঃ
চারা তৈরি করতে খুব বেশি হ্যাপা নেই। তবে কতকগুলো ব্যাপার আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন, এই বছর যে চারাগুলো আপনি বসাবেন, সেগুলো দেখবেন, মরসুম শেষ হয়ে গেলেও ফল দিয়ে মরে যাচ্ছে না। আসলে, স্ট্রবেরি গাছ কয়েক বছর বাঁচে। তাই মরসুম শেষ হয়ে গেলেও নষ্ট না-করে গাছগুলো টবেই রেখে দেবেন। যেমন যত্ন করছিলেন, যেমন খাবার দিচ্ছিলেন দিতে থাকবেন। এপ্রিলের শুরু বা মাঝামাঝি থেকে দেখবেন গাছের পাতার কোল থেকে আবার লম্বা লম্বা ডাঁটি বেরুচ্ছে, যেমন ফুল ফোটার সময় বেরিয়েছিল, ঠিক তেমনি। তবে এবার দেখবেন ডাঁটির মাথায় কলি নয়, দেখা যাচ্ছে একটা ফোলা অংশ এবং তা থেকে বেরিয়ে রয়েছে অতি ক্ষুদে ক্ষুদে দুটো পাতা। এই ফোলা অংশটি ওই ডাঁটির সঙ্গে লেগে থাকা অবস্থাতেই কোন টব বা পটের মাটিতে ডুবিয়ে চেপে দেবেন; দেখবেন, ক’দিনেই তা থেকে শেকড় বেরিয়ে নতুন চারারূপে বাড়তে শুরু করেছে। যখন দেখবেন চারাটি বেশ সতেজ হয়ে বেড়ে উঠেছে, বেশ কয়েকটি বড় বড় পাতা ছড়িয়ে ফেলেছে; তখন ডাঁটি কেটে মূল গাছ বা মা-গাছ থেকে তাকে আলাদা করে দেবেন। ব্যস, এতেই আপনার আলাদা একটি চারা তৈরি হয়ে যাবে। এভাবেই একের পর এক চারা তৈরি করে নিতে পারবেন আপনি নিজে নিজেই।
দেখলেন তো, কত সহজে ছাদ বা ব্যালকনি বাগানে স্ট্রবেরি চাষ করা যায়! তাহলে আর দেরি কেন, আজই লেগে পড়ুন চাষে। স্ট্রবেরি তো শুধু সুস্বাদু ফলের গাছ নয়; পাতা, ফুল ও ফলের অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে সে আপনার ছোট্ট সাধের বাগানকে এক্কেবারে ভরিয়ে রাখবে। সেও তো এক বাড়তি পাওনা, তাই না...