সতীপীঠঃ জলন্ধরে রয়েছেন সন্তানের মঙ্গলকারিণী স্তনদাত্রী-মাতৃরূপে দেবী ত্রিপুরমালিনী’

পাঞ্জাবের জলন্ধর। ‘জলন্ধর’ আমাদের অতিপরিচিত প্রাচীন এক ধর্মীয় স্থান। এই স্থানের উৎপত্তি নিয়ে একটি পৌরাণিক কাহিনি রয়েছেঃ

পৌরাণিক যুগে জলন্ধর নামে এক অসুর ছিল। মহাদেব একবার বিশালকায় বিকট ও কদাকার এক পুরুষের রূপধারণ করে আকাশে বিচরণ করছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র হঠাৎ তাঁকে দেখে ভয় পেয়ে তাঁর মাথায় বজ্রের আঘাত হানেন। সেই আঘাতে তাঁর মাথা থেকে দারুণ অগ্নি নির্গত হয়ে ইন্দ্রকেই ভস্ম করতে উদ্যত হয়। তখন ইন্দ্র নিজের ভুল বুঝতে পেরে এবং মহাদেবকে চিনতে পেরে তাঁর শরণ নিয়ে বারংবার ক্ষমা চাইতে থাকেন। এতে মহাদেব তুষ্ট হয়ে সেই দারুণ অগ্নিকে সংবরণ করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। অগ্নি সমুদ্রের বুকে পড়তেই তা থেকে দুর্ধর্ষ এক বালকের জন্ম হয়। সমুদ্র সেই বালককে বড় করার দায়িত্ব দেন ব্রহ্মাকে। ব্রহ্মা বালকের নাম দেন ‘জলন্ধর’ এবং তাকে শিব ছাড়া অন্য অন্য কেউ বধ করতে পারবে না, এমন বর দিয়ে বসেন।

ব্রহ্মার বর ও প্রশ্রয় পেয়ে বড় হয়ে জলন্ধর এমন বেপরোয়া হয়ে উঠল যে, তার ত্রাসে ত্রিলোক একেবারে ‘ত্রাহি ত্রাহি’ করে উঠল। প্রথমে ইন্দ্রের হাত থেকে স্বর্গ ছিনিয়ে সে সমস্ত দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করলো। এরপর মর্ত ও পাতাললোক অচিরেই তার পদানত হল। সকলকে সে অত্যাচারে অত্যাচারে একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলল। সকলের কাতর প্রার্থনায় অবশেষে মহাদেব সমরে নেমে অনেক ছলনার বিনিময়ে জলন্ধরকে হত্যা করলেন। মৃত্যুর সময় জলন্ধরের শুভবুদ্ধির উদয় হল। সে দেবাদিদেবের কাছে প্রার্থনা জানালো যে, তার মৃতদেহ যেখানে পতিত হবে, সেখানে যেন নানান পবিত্র ধর্মস্থান গড়ে ওঠে। জলন্ধরের এই শেষ ইচ্ছা জেনে মহাদেব খুব তুষ্ট হলেন। বললেন, ‘তথাস্তু’!

পৌরাণিক এই কাহিনি অনুযায়ী, অসুর জলন্ধরের মৃতদেহ যে-স্থানে পতিত হয়েছিল, সেই স্থানটি তারই নামে ‘জলন্ধর’ নামে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে। হয়ে রয়েছে পঞ্চোপাসক হিন্দুদের নানান ধর্মস্থানের সমন্বয়ে পবিত্র এক তীর্থভূমি।

পবিত্র এই তীর্থভূমিতে অসংখ্য মঠ-মন্দিরের মাঝে রয়েছে দেবী সতীর একান্নপীঠের অন্যতম এক পীঠও। কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই পীঠের সঙ্গে জুড়ে আছে আদিগুরু শঙ্করাচার্যের নাম। এই পীঠকে বলা হয়, ‘স্তনপীঠ’। কেননা, ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে এখানে পতিত হয়েছিল দেবী সতীর বামদিকের স্তন। কথিত আছে যে, দেবীর এই দেহাংশ এই ভূমিতে পতনের পর তা শিলায় পরিণত হয়। শত শত বছর আগে আদিগুরু শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষের প্রাচীনতীর্থ উদ্ধারের জন্য ভ্রমণ করতে করতে এই পীঠস্থানে একদা হাজির হন। এখানে এসেই তিনি দেবীর দেহাংশের উপস্থিতি অনুভব করেন। এবং সেই অনুভবের পথ বেয়ে এই ভূমিতে অবস্থিত পবিত্র পুষ্করিণীর জলের তলা থেকে সেই পবিত্র শিলাখণ্ড উদ্ধার করে পুষ্করিণীর পাড়েই স্থাপন করে পূজা করেন। পবিত্র সেই শিলাখণ্ড গোপন রাখতে তিনি তার ওপর একটি দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে এই স্থানেই দেবীর ছোট্ট অথচ সুদৃশ্য একটি মন্দির গড়ে ওঠে।

প্রাচীন পুষ্করিণীটি আজও বিদ্যমান রয়েছে স্বমিমায়। আকারে এটি বেশ বড়ো। বর্তমানে এর চারিদিক কংক্রিটের রেলিং দিয়ে বাঁধানো। এর তলদেশ থেকে যেহেতু দেবীর শিলাভূত দেহাংশ উদ্ধার হওয়ার কথা প্রচলিত রয়েছে, ভক্তজন তাই এই পুষ্করিণীকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন। তাঁদের বিশ্বাস, এই পুষ্করিণীর জলে স্নান করলে সমস্ত পাপের বিনাশ ঘটে। তাই এখানে আগত ভক্তজন দেবীকে পূজাদানের পূর্বে এই পবিত্র পুষ্করিণীতে স্নান করে থাকেন। হিন্দিতে পুষ্করিণীকে বলে, ‘তালাও’। দেবীর সঙ্গে এই পবিত্র ‘তালাও’কে জুড়ে স্থানীয় মানুষ তাই এই পীঠমন্দিরকে ‘দেবী তালাও মন্দির’ বলেও ডেকে থাকেন।  

জলন্ধর রেলস্টেশন থেকে এক কিলোমিটার দূরেই এই পবিত্র পুষ্করিণী ও তার পাড়ে পীঠমন্দিরটি অবস্থিত। পুষ্করিণীটি অনেক প্রাচীন হলেও পীঠমন্দিরটি খুব বেশি প্রাচীন নয়। পীঠমন্দিরটি মাত্র দুশো বছর আগে নির্মিত হয়েছিল (কার দ্বারা, কীভাবে নির্মিত হয়েছিল সে-সবের প্রকৃত ইতিহাস জানা যায় না)। তারপর কালের প্রহারে কিছুটা জীর্ণ হয়ে পড়ায় পরবর্তীকালে তাকে সংস্কার করে বর্তমান রূপটি দেওয়া হয়েছে। মন্দিরটি খুব বেশি উঁচু নয়, তবে সুদৃশ্য। চৌকো আকারের এই মন্দিরের ছাদের কিনার ঢেউ খেলানো, তার ওপরে রয়েছে চারচালা সুতীক্ষ্ণ ও সুদীর্ঘ চূড়া। চূড়াটিকে সোনালি রঙে রঞ্জিত করায়, তা আরও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে।

পীঠমন্দিরের সুবিশাল চত্বর রয়েছে। যার মেঝে নির্মিত হয়েছে সাদাকালো মার্বেল পাথর দিয়ে। চত্বর থেকে পীঠমন্দিরের যাওয়ার জন্য ভক্তজনের গ্রীষ্ম-বর্ষায় লাইন দেওয়ার সুবিধার কথা মাথায় রেখে কর্তৃপক্ষ সুন্দর লম্বা শেড বানিয়ে দিয়েছেন। চত্বর থেকে পীঠমন্দিরে যাওয়ার পথে একদিকে একটি প্রাচীন ও বৃহৎ অশ্বত্থ গাছ রয়েছে। তাতেই রয়েছে দেবীর দোলনা। গাছটির চারপাশ গোল করে বাঁধানো। ভক্তজনের বিশ্বাস, দেবী এখানেও সর্বদা বিরাজ করেন। এখানে ধূপদীপদান করে মানত করলেও দেবী তা পূরণ করেন, তাই এই অশ্বত্থ সকলের কাছে ‘কল্পবৃক্ষ’ নামে পরিচিত।

কল্পবৃক্ষ পেরিয়ে দেবীর পীঠমন্দিরে যেতে বারোটি সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। গর্ভগৃহে অপূর্ব সুন্দর ও সুগন্ধী ফুলের মালায় সাজানো নয়নাভিরাম দেবীর বেদি। অখণ্ডশিখা একটি প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত রয়েছে সেই বেদির কাছে। এই দীপের শিখা প্রাচীন সময় থেকে আজ পর্যন্ত কখনোই নির্বাপিত হতে দেওয়া হয়নি। প্রদীপের আলোয় দেখা যায়, বেদির রঙিন দেওয়ালে লগ্ন হয়ে রয়েছে চালচিত্র। দেবীমূর্তির উচ্চতা ফুট দেড়েকের বেশি নয়। মূর্তিটি সাদা মর্মরে নির্মিত কিন্তু রঙিন। দেবীর দু’পাশে রয়েছেন ছোট্ট ছোট্ট মূর্তিতে রয়েছেন গণেশ ঠাকুর। মূর্তিতে দেবী শক্তিরূপিনী। সিংহবাহিনী। দেবী চতুর্ভুজা। তাঁর চারটি হাতে রয়েছে নানান আয়ুধ ও বরাভয়। মাথায় রয়েছে রত্নমুকুট। নাকে ও কানে রত্ন-অলঙ্কার। গলায় রয়েছে একইসঙ্গে রত্নমালা ও পুষ্পমালা। অঙ্গে রয়েছে হলুদ বসন। দেবীর নিম্নাংশ জরিদার বস্ত্র ও পুষ্পে আচ্ছাদিত। সেখানে সতীঅঙ্গের শিলাভূতরূপটি আচ্ছাদিত রয়েছে কি না, এই মূর্তিই শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত মূর্তি কি না, তা জানা যায় না। তবে দেবীমূর্তির রূপে অপূর্বসুন্দর এক প্রসন্নতা লগ্ন হয়ে রয়েছে। তাঁর রন্তিম ঠোঁটের স্মিত হাসি আর দুই চোখের স্নিগ্ধ দৃষ্টি ভক্তজনকে যুগপৎ শান্তি ও আশ্রয় দান করে।

দেবীর নাম, ‘ত্রিপুরমালিনী’। ‘পীঠনির্ণয়’ তন্ত্রগ্রন্থে একটি শ্লোকে বলা রয়েছে— ‘ভীষণা ভৈরবস্তত্র দেবী ত্রিপুরমালিনী’। অর্থাৎ দেবী এখানে ‘ত্রিপুরমালিনী’ এবং তাঁর ভৈরব মহাদেব ‘ভীষণ’ নামে পূজিত হন।

কিংবদন্তি অনুসারে, বশিষ্ঠ, ব্যাস, মনু, জমদগ্নি, পরশুরাম প্রভৃতি পুরাণখ্যাত ঋষিগণ জলন্ধরের এই পীঠস্থানে এসে দেবী আদ্যাশক্তির আরাধনা করেছিলেন এবং পরিশেষে দেবীর কৃপালাভও করেছিলেন। দেবী আদ্যাশক্তি এখানে তাঁদের ‘ত্রিপুরমালিনী’রূপেই দর্শন দিয়েছিলেন। দেবী সতীর স্তন এখানে পতিত হয়েছিল বলে ভক্তজনের কাছে যুগে যুগে স্তনদায়িনী জননীরূপে বাৎসল্যময়ী মাতারূপেই দেবী ত্রিপুরমালিনী আরাধিত হন। তাঁদের বিশ্বাস, এই দেবী যেহেতু সাক্ষাৎ মাতৃরূপিণী, তাই তিনি সন্তানহীনাকে সন্তান দেন; সন্তানবতীকে রক্ষা করেন এবং ভক্তজনের সন্তানের মঙ্গল করেন। এ-কারণেই অনেক ভক্তজন সন্তানকে সঙ্গে নিয়েই এই মন্দিরে আসেন দেবীর পূজা দিতে, দেবীর চরণে মাথা ঠেকিয়ে সাক্ষাৎ কৃপা আহরণ করতে। ভক্তজনের আরও বিশ্বাস, দেবী ত্রিপুরমালিনীর আরাধনায় একযোগে মাতা বৈষ্ণোদেবী, মা লক্ষ্মী ও দেবী সরস্বতীকে উপাসনার ফল পাওয়া যায়। কেননা, এই তিন দেবী ও দেবী ত্রিপুরমালিনী হলেন অভিন্ন। অনেকের বিশ্বাস, যদি কেউ এই মন্দিরে মারা যায় সে মানুষ হোক বা কোন পশুপাখি—তার মোক্ষলাভ হয়, পুনর্জন্ম হয় না। বলা বাহুল্য যে, এই সব কিংবদন্তি ও ভক্তজনের বিশ্বাসের মধ্যে প্রামাণ্য সত্যতা কিন্তু কিছুই নেই।

যাই হোক, দেবীর পীঠমন্দির ছাড়িয়ে পবিত্র পুষ্করিণীর পাড়ে একের পর এক বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মন্দির রয়েছে। এগুলোর কিছু প্রাচীন, কিছু নবীন। রয়েছে প্রাচীন কালিকা মন্দির, পরশুরাম মন্দির, বালাজি মন্দির, ভৈরব ‘ভীষণ’-এর মন্দির। ভৈরব ভীষণ মন্দিরে মহাদেবের প্রাচীন একটি লিঙ্গমূর্তি রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে হলুদবর্ণের ভৈরববেশী মহাদেবের মূর্তি।     এখানে সম্প্রতি তৈরি হয়েছে অমরনাথ গুহার অনুকরণে একটি গুহামন্দির। সেটির নির্মাণও বেশ নয়নাভিরাম।

মন্দিরে রবিবার ও মঙ্গলবার খুব ভিড় হয়। কেননা, এই দুই বিশেষবারে অসংখ্য ভক্তজন দেবীর পুজো দিতে আসেন। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় এই মন্দিরে ভজন-সঙ্গীতের আসর বসে। এই আসরে স্থানীয় ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভজনশিল্পীরা সমাগত হয়ে সুশ্রাব্য সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে দেবীর ভজনা করেন। প্রতি বছর এপ্রিল মাসে মন্দির ঘিরে মেলা বসে। এই সময় বিশেষ বার্ষিক পূজার আয়োজন করা হয়। এই পূজা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভক্তজন একত্রে মিলিত হয়ে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে মেতে ওঠেন। চৈত্র মাসে নবরাত্রি উৎসবও এই মন্দিরে খুব ধুমধামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় দারুণ জাঁকজমকের সঙ্গে প্রতিদিন দুপুরে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় ভজন-সঙ্গীতেরও আয়োজন করা হয়। বলা বাহুল্য, এই সময় এত ভক্তের আগমন ঘটে যে, মন্দির ও মন্দিরের নিজস্ব ধর্মশালায় তিলধারণের স্থান থাকে না।...   

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...