মেঘে ঢেকে যায়নি যে তারা

১৯৪৭ সাল। ভারত স্বাধীন হল। কিন্তু বদলে দ্বিখণ্ডিত হল বাংলার হৃদয়। ভাগ হয়ে গেল বাংলা। ক্ষতবিক্ষত হলো অসংখ্য মানুষের অন্তর। দুঃখযাপন বোধহয় সবচেয়ে কঠিন কাজ। ক্ষতবিক্ষত বাংলার অন্তরাত্মার গ্লানি প্রত্যেক মানুষের হৃদয়েই পৌঁছেছিল নিজের মতো করে। একটা মানুষ। যে ছবি বানাতে ভালোবাসে। কবিতা লেখে, নাটক লেখে। বাংলা ভাগ হওয়ার দুঃখ বার বার উঠে এলো সেই মানুষটার বানানো সিনেমাতে। আশ্চর্য কুয়াশাময় সিনেমাগুলো। দুঃখের গল্প বলে। যন্ত্রণার কাহিনী শোনায়। সিনেমাগুলো সেই মানুষজনেদের নিয়ে ছবি আঁকে যাকে কেউ চেনে না। অথচ সেই সিনেমাগুলোর শেষে একটা শুরু লুকিয়ে থাকে যেন। ওই সিনেমাগুলোর শেষে এক জীবন যাত্রার শুরু লুকিয়ে থাকে। ঋত্বিক ঘটক তেমনই এক পরিচালকের নাম। ১৯২৫ এর ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের ঢাকায় জন্ম তাঁর। জীবন মানুষের তৈরি করা গলি পথ বেয়ে বারবার উঠে এসেছে দর্শকের চোখের সামনে, তাঁর সিনেমার মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালে প্রথম নাটক লিখেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। "কালো সায়র"।

ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করত তৎকালীন থিয়েটার এবং চলচ্চিত্র জগতের মানুষেরা। "নবান্ন" নাটকটি এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৪ সালে বিজন ভট্টাচার্যের লেখা এবং পরিচালিত নাটক "নবান্ন" সমগ্র দেশে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সেই সময়কার আন্দোলনগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল ওই নাটক। সারা দেশে মঞ্চস্থ হয় এই নাটক, প্রতিবাদ স্বরূপ। ব্রিটিশ অত্যাচার, ষড়যন্ত্র এবং বাংলা ভাগ করার মত অসংবেদনশীল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল এই নাটকের মঞ্চস্থ হওয়া। মহাকালের অমোঘ নিয়মে এই নাটক এক কুড়ি বছরের তরুণের মনেও গভীর ভাবে দাগ কেটে চলছিল। পরবর্তীকালে সেই তরুণ যখন সিনেমা পরিচালনা করতে শুরু করে, "নবান্ন" নাটকটি তাঁকে অনেকখানি প্রভাবিত করেছিল। "নবান্ন" নাটকের সঙ্গে যুক্ত থাকা আন্দোলনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল যুবকটি। দেশপ্রেমের ভাবনায় এতটাই আপ্লুত ছিলেন ঐ যুবক - ঋত্বিক ঘটক। পরবর্তীকালে তাঁর পরিচালিত সমস্ত সিনেমারই বিষয় ছিল সংগ্রাম। একজন সাধারণ মানুষকে প্রতি পদক্ষেপে যে সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয় অন্তরে এবং বাইরে, তাই ছিল ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার মূল উপজীব্য। তাঁর বেশিরভাগ সিনেমাই সমাজের প্রতিচ্ছবি। ‌বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী খন্ডিত বাংলা যে তাঁর অন্তরকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছিল, তা উঠে এসেছে তাঁর পরিচালিত বেশিরভাগ ছবিতে। থিয়েটার জগতের সঙ্গে অন্তরের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন তিনি। ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন।

১৯৫০ সালে নিমাই ঘোষ পরিচালিত "ছিন্নমূল" সিনেমায় অভিনেতা এবং সহকারি পরিচালক হিসেবে এই জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ঋত্বিক ঘটকের। তাঁর নিজের পরিচালিত প্রথম সিনেমা "নাগরিক"। বঙ্গভঙ্গ নিয়ে তাঁর তিন পর্বের কালজয়ী সিনেমা "মেঘে ঢাকা তারা", "কোমল গান্ধার", এবং "সুবর্ণরেখা" বাংলা চলচ্চিত্র জগতে আর্ট ফিল্মকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিল। পুনের "ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া"য় দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন তিনি। বর্তমান যুগের অনেক বিখ্যাত পরিচালকই তাঁর ছাত্র ছিল। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়েও দুটি সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন। বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে আর্ট ফিল্মএর সঙ্গে দর্শকদের প্রথম পরিচয় ঘটিয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক। "নাগরিক" সিনেমার মাধ্যমে। তাঁর লেখা চিত্রনাট্য নিয়ে তৈরি একমাত্র কমার্শিয়াল হিন্দি ছবি "মধুমতি"। ঋত্বিক ঘটকই সিনেমার জগতে প্রথমবার পুনর্জন্ম বিষয়টির সঙ্গে দর্শকদের পরিচিতি ঘটান এই হিন্দি সিনেমাটির মাধ্যমে। তিনি মনে করতেন সাংস্কৃতিক জগতেরও সমাজের প্রতি একটা দায়িত্ব থাকে। তাই তাঁর প্রত্যেকটি সিনেমাই সমাজের প্রতি কোন বার্তা দেয়। "তিতাস একটি নদীর নাম" সিনেমাটি তাঁকে অসাধারণত্বের উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। তিনি মনে করতেন ছবি নির্মাণ করা একটি শিল্প, এই শিল্পের মূল লক্ষ্য মানুষের সেবা করা। মানুষের কষ্ট, যন্ত্রণা, আনন্দ, অনুভূতি সবকিছু যে সিনেমার মাধ্যমে ছোঁয়া যায়, তা অনুভব করিয়েছিলেন এই কালজয়ী পরিচালক। ১৯৭৪ সালে মূল কাহিনীর জন্য তাঁর 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো' সিনেমাটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। ১৯৭০ সালে ভারত সরকার তাকে "পদ্মশ্রী" সম্মানে ভূষিত করেন। তাঁর জীবন, চিন্তাভাবনা, নাটক, কবিতা, সিনেমা শুধু চলচ্চিত্র জগতের ক্ষেত্রেই নয়, মানুষের বেঁচে থাকার যাত্রাপথের ক্ষেত্রেও মাইলস্টোন। তার সংকলন নিয়ে রচিত বই "সিনেমা অ্যান্ড আই" অন্তরের অন্তপুরের পথপ্রদর্শক।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...