কাশীদাসী ‘মহাভারত’ আর চোপড়াদের দূরদর্শনের ক্লাসিক ধারাবাহিকের কল্যাণে আপামর বাঙালির সকলেই বিরাট দেশের কথা সকলেরই জানা। সকলেই জানেন যে, বারো বছর বনবাস শেষে পাণ্ডবেরা ছদ্মবেশে এক বছর এখানেই বিরাটরাজার আশ্রয়ে অজ্ঞতবাস যাপন করেছিলেন। হ্যাঁ, রাজার নাম বিরাট। আর বিরাট দেশ ছিল তাঁরই রাজধানী। এই বিরাটরাজার গোধন চুরি করে কুরুপুত্রেরা পাণ্ডবদের হাতে প্রকৃষ্টরূপে প্রহৃত হয়েছিলেন। ‘বিরাট দেশ’ মহাভারতের দ্বান্দ্বিক নাটকে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, তা নিয়ে একটি আলাদা পর্বই বিন্যস্ত করতে হয়েছিল মহাভারতের রচনাকারকে এবং আমরা জানি সেই পর্বের নাম, ‘বিরাট পর্ব’। হিন্দুদের শ্রাদ্ধকর্মে এই ‘বিরাট পর্ব’ বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে পঠিত হয়। এই পর্ব পাঠ ও শ্রবণের মধ্য দিয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সমাপন ঘটে। উনিশ শতক থেকে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের ছাপানো ‘গীতা’ দান ও মহাভারতের ‘বিরাট পর্ব’ দান করার রীতি এখনও অনেকেই পালন করেন। ফলত, এই ‘বিরাট পর্ব’ আলাদা করে আজও বই হিসেবে এই কারণে ছাপা হয়।
যাই হোক, শুধুই যে মহাভারতীয় কাহিনিসূত্রে এই বিরাট দেশ আপামরের কাছে প্রিয়, তা কিন্তু নয়; এই স্থান একান্নপীঠের অন্যতম এক পীঠ হিসেবেও হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। স্থানীয় জনশ্রুতিতে মহাভারতের কাহিনির সঙ্গে এই পীঠের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, স্বয়ং জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠির এই পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর পুজো করেছিলেন এবং দেবীর কৃপালাভ করেছিলেন। আমরা জানি যে, একান্নপীঠের প্রতিটি পীঠই গড়ে উঠেছে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হওয়ার পর দেবী সতীর কোন-না-কোন দেহাঙ্গ নানান স্থানের মাটিতে পতনের ফলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিরাটে দেবীর কোন অঙ্গ পতিত হয়েছিল? এ-প্রসঙ্গে ‘পীঠনির্ণয়’ তন্ত্রগ্রন্থে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে—
‘বিরাট দেশ মধ্যে তু পাদাঙ্গুলি নিপাততম্
ভৈরবশ্চামৃতাক্ষশ্চ দেবী তত্রাম্বিকা স্মৃতা।’
শ্লোকটির অর্থঃ বিরাট দেশে দেবীর পায়ের আঙুল পতিত হয়েছিল। (কিন্তু কোন পায়ের আঙুল, সেটা বলা নেই শ্লোকে। তবে সাধারণের বিশ্বাস, এখানে দেবীর বাঁ-পায়ের চারটি আঙুল পতিত হয়েছিল)। দেবী এখানে ‘অম্বিকা’ নামে পূজিতা হন; দেবীর ভৈরবের নাম ‘অমৃতাক্ষ’।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে এই বিরাট দেশ কোথায় অবস্থিত? আসলে, মহাভারতের বিরাট দেশ, এখন শুধু একটি ছোট্ট জনপদমাত্র। সেটি একটি গ্রাম। বিরাট গ্রাম। এই গ্রাম রাজস্থানের জয়পুর থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গ্রামের চারিদিকে শ্যামল-সবুজ পাহাড়ের বৃত্ত। তারই মাঝে একটি পাহাড়। তারই চূড়ায় অবস্থিত দেবীর পীঠ ও মন্দির। পাহাড়ের নীচ থেকে পীঠস্থানে যাওয়ার বেশ প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে। পীঠমন্দিরটি রাজস্থানীদের সাধারণ বাড়ির মতোই দেখতে। দেওয়ালে বা মন্দিরের গায়ে কোন কারুকার্য নেই। একেবারেই সাদামাঠা রূপ তার। তবু তার মধ্যেই মন কেমন করা এক উদাসী ও ত্যাগ-তিতক্ষার দর্শনময় একটি ব্যক্তিত্ব রয়েছে এই মন্দিরের। ফিকে গেরুয়া রঙে রঞ্জিত রয়েছে দেওয়াল। মন্দিরের দরজায় প্রবেশ করলে প্রথমেই পড়ে প্রশস্ত মণ্ডপ। মণ্ডপের তিনদিকের দেওয়ালে দরজা। মেঝের মধ্যিখানে রয়েছে একটি যজ্ঞকুণ্ড। মণ্ডপের গা ঘেঁষে তৃতীয় দরজার লাগোয়া মূল মন্দির। মন্দিরটি খুব প্রশস্ত নয়। তবে উচ্চতায় মণ্ডপের সমান এবং মাথার উপর একটি সুন্দর নিটোল গম্বুজ রয়েছে।
মন্দিরের গর্ভগৃহে একটি উঁচু বেদিতে দেবীর অবস্থান। দেবীর মূর্তি প্রায় দেড় থেকে দু’ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট। দেবীর দেহ শ্বেতপাথরে নির্মিত। মাথায় রত্নমুকুট, কণ্ঠে রত্নহার। ফুলের মালা। দেবীর দুই চোখ উজ্জ্বল। রৌপ্যনির্মিত। তবু তাতে প্রশান্তি ও বরাভয়ের আশ্রয় রয়েছে। তাঁর ঠোঁটে মৃদু হাসি। দেবীর সর্বাঙ্গ লাল জরিদার নক্সাওয়ালা কাপড়ে ঢাকা। তাঁর হাত, পা ও অবস্থিতির স্থান প্রত্যক্ষ করা যায় না। তবে দেবীর পাদভূমির দু’ পাশে দুটি বৃহৎ শঙ্খ। দেবীর ডানদিকে হিংস্র-ক্রুদ্ধ সিংহ। দূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে সে রয়েছে দাঁড়িয়ে। গর্ভগৃহের একদিকে একটি ধাতব পিঞ্জরের মধ্যে প্রজ্জ্বলিত রয়েছে অখণ্ডজ্যোতি প্রদীপ। অলেখকাল থেকে তার শিখা এখনও নির্বাপিত হয়নি।
মন্দিরের বাইরেই প্রশস্ত বাঁধানো চাতাল। এই চাতালের ওপর ঠিক মণ্ডপ ও মন্দিরের সীমারেখায় একটি ছোট্ট ফুট-তিনেক উচ্চতার মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটিও খুব সাধারণ দেখতে। এই মন্দিরেই রয়েছে ছোট্ট ফুটখানেক উচ্চতার একটি শিবলিঙ্গ। দেখলেই মনে হয়, শিবলিঙ্গটি অত্যন্ত প্রাচীন। ইনিই দেবী অম্বিকার ভৈরব অমৃতাক্ষ। ভক্তজন তাঁকে ‘অমৃতেশ্বর’ নামেও ডেকে থাকেন। ভৈরব হলেন দেবীর রক্ষক বা রক্ষাকর্তা। লক্ষণীয় যে, অমৃতাক্ষ মহাদেব যাতে দেবী অম্বিকার রক্ষকের ভূমিকা যথাযথভাবে চালিয়ে যেতে পারেন, তার জন্যই যেন তাঁর অবস্থান দেবীর মন্দির ও মণ্ডপের ঠিক মধ্যবর্তী অঞ্চলে রাখা হয়েছে।
পরিশেষে বলি যে, একান্নপীঠের অন্তর্গত অন্যান্য সতীপীঠের তুলনায় এই পীঠ যেন কিছুটা উপেক্ষিত। রাজস্থানের গৌরবময় পর্যটনস্থানের মোহ এড়িয়ে খুব কম বাইরের দর্শনার্থীই এখানে আসেন। ফলে, নিত্যপুজোয় এই স্থানে ভক্তজনের ভিড় কিছুটা কমই হয়। তবে আশ্বিন ও চৈত্র মাসের নবরাত্রি উৎসব, শিবরাত্রি, রামনবমী, মকর-সংক্রান্তি প্রভৃতি পার্বণ এখানে খুব ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। তখন বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয় ও বিপুল সমারোহে যজ্ঞানুষ্ঠান উদযাপিত হয়। এই উপলক্ষে স্থানীয় ভক্তদের ভিড় যেমন উপচে পড়ে, তেমনি অনেক বাইরের ভক্তজনও এই সমারোহে যোগ দেন। তাঁরা মহাভারতের কাহিনির সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশ-গ্রাম বিরাটে হাজির হয়ে জ্যেষ্ঠপাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে কৃপাদানকারী দেবীর চরণে মাথা ঠেকিয়ে ধন্য হন। এভাবেই অন্তরে লীন হয়ে এগিয়ে চলে দেবী-কৃপার পরম্পরা অনাগত দিনের পথে।...