দুগ্গা কথা: জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়ির পুজো

শরতের নীল আকাশ জানান দিচ্ছে পুজো আগত। প্রকৃতিও সেজে উঠেছে নিজের মতো করে। সাজো সাজো রব, ম্যারাপ বাঁধা চলছে। সাবেকি আর থিমের লড়াইয়ের মাঝে আজ দুগ্গা কথায় ফের একবার বনেদি বাড়ির পুজো। জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়ির দুর্গা পুজো। কলকাতার অন্যতম সেরা পুজো হল এই দাঁ বাড়ির পুজো। উনবিংশ শতকের শেষ ভাগ, কলকাতা বেশ ধারে ভারে বড়। সেই সঙ্গে বাংলার নানা প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা ভাগ্যান্বষণে কলকাতায় আসতে শুরু করলেন। ঠিক সেইভাবেই বর্ধমানের সাতগাছিয়া থেকে  কলকাতায় আসেন গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের দাঁ পরিবারের প্রাণপুরুষ গোকুলচন্দ্র দাঁ। ব্যবসাসূত্রে প্রচুর টাকা উপার্জন করে জোড়াসাঁকো অঞ্চলে ঠাকুরদালানসহ বসত বাড়ি নির্মাণ করলেন তিনি। ১৮৪০ থেকে সেখানেই দুর্গাপুজোর শুরু। ওই বছরই গোকুলচন্দ্র তার এক আত্মীয়ের চার বছরের পুত্র শিবকৃষ্ণকে দত্তক নেন। সেই অর্থে এই বছর দাঁ বাড়ির পুজো ১৮২ বছরে পা দিতে চলেছে। বর্তমান এই বাড়ির ঠিকানা ১২ শিবকৃষ্ণ দাঁ লেন। গোকুলচন্দ্রের দত্তকপুত্র শিবকৃষ্ণ পারিবারিক ব্যবসাকে আরও বড় করে তোলেন। শিবকৃষ্ণের আমলেই এই বাড়ির দুর্গাপুজোর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, বৈভব-আড়ম্বর বৃদ্ধি পায়। শিবকৃষ্ণ দাঁ-র সময়কাল ছিল জোড়াসাঁকো দাঁ পরিবারের স্বর্ণযুগ। পারিবারিক লোহা, কয়লা আর হার্ডওয়ারের ব্যবসায় প্রভূত লাভ করেন তিনি। সেই সময়ে আসানসোল এলাকায় বেশ কিছু কোলিয়ারি কিনে সেখানে রেললাইন তৈরির বরাত পান। লাভের টাকার একটা বড় অংশ শিবকৃষ্ণ দুর্গাপুজোয় ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন। জোড়াসাঁকোর সিংহী বাড়ির সন্তান কালীপ্রসন্ন সিংহের 'কলকাতার বারোইয়ারী পূজা'র প্রধান চরিত্র ছিলেন বীরকৃষ্ণ দাঁ, কেবলচন্দ্র দাঁ-এর পুষ্যিপুত্র। এই বীরকৃষ্ণই ছিলেন জোঁড়াসাকো দাঁ পরিবারের শিবকৃষ্ণ দাঁ। কালী সিংহী বীরকৃষ্ণের যা বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে শিবকৃষ্ণের হুবহু মিল পাওয়া যায়।
 
maxresdefault (10)
সেকালের কলকাতায় প্রবাদ ছিল, দেবী মর্ত্যে এসে গয়না পরেন জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে। দাঁ এই বাড়ির প্রতিমার সুখ্যাতি ছিল অলঙ্কারের জন্যে। একদা নাকি দুর্গাপ্রতিমাকে সাজানোর জন্য প্যারিস আর জার্মানি থেকে হিরে আর চুনী বসানো গয়না আমদানি করতেন শিবকৃষ্ণ। আগের মতো না হলেও এখনও দাঁ-বাড়ির পুজোয় মাকে বহুমূল্য অলঙ্কার পরানো হয়। শিবকৃষ্ণের স্বর্ণালঙ্কারের প্রতি আকর্ষণ ছিল। শিবকৃষ্ণ দাঁ সাজগোজ করতে বড় ভালবাসতেন। সারাক্ষণ তিনি কয়েক ভরি সোনার গয়না পরে থাকতেন। একদিন ভাবলেন দেবী দুর্গাকেও মনের মতো করে একইভাবেই অলংকারে সাজাবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। শোনা যায়, সম্ভবত জার্মানি স্বর্ণ-মানিক্য খচিত ভেলভেটের মেরুন শাড়ী আনা হয়েছিল। আনুমানিক ১৫০ বছরেরও অধিক সময় ধরে প্রতিবার পুজোর সময় এই একই ভেলভেটের শাড়ীতে সেজে ওঠেন দাঁ বাড়ির 'কন্যা' দুর্গা। আর এ শুধু মায়ের জন্য নয়, তার চার ছেলে, মহিসাসুর এমনকি দেবীবাহন সিংহের জন্যও একই ব্যবস্থা। বিদেশ থেকে আনা 'মেটালিক' স্বর্ণালী পাতে সাজানো হয় একচালা। সাবেকি একচালা ডাকের সাজের বাংলা শৈলীর মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা। 
 
শোনা যায়, সেই সময়ে তিনি ঠাকুরকে পরানোর জন্য ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে বিশেষ কাজ করা অলঙ্কার ও পোশাক আনালেন। সেই পোশাকে ভারী সোনালি রুপোলী জরির কাজ আর কিছু দামি পাথর খচিত ছিল। সে সময় অমন পোশাক কেউ দেখেইনি। পোশাক এবং দেবীর অলঙ্কার এতটাই সুন্দর আর মনোমুগ্ধকর ছিল যে তখন মুখে মুখে চালু হয়ে গিয়েছিল যে দেবী মর্ত্যে এসে প্রথম দাঁ বাড়িতে পোশাক এবং অলঙ্কার পরে সাজেন। তারপর অন্য জায়গায় যান। সেই পোশাকই কিন্তু এখনও দেবী পরেন এই বাড়িতে। এছাড়াও সেই সময় দেবীর চালচিত্রের কিছু অংশ জার্মানি থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল বলে জানা যায়। চালচিত্র উজ্জ্বল এবং ঝকঝকে করার জন্য তামা ও পিতল দিয়ে তৈরি একরকম ধাতুর পাত শিবকৃষ্ণ আনিয়েছিলেন। প্রতিমার চালচিত্রে আজও এই পাত ব্যবহৃত হয়। এই পরিবারে ঠাকুরের জন্য যে ছাতা ব্যবহার করা হয় সেটি মোলায়েম ভেলভেটের কাপড়ের তৈরি, সেই সঙ্গে সোনা এবং রূপোর জরির কাজে ঠাসা। এই ছাতাটি কলা বউ স্নান করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।
 
বাড়ির পুজো হয় নিজেদের ঠাকুর দালানে। গোকুলচন্দ্রের অভিনয়ের শখ ছিল, তাঁর আমলেই দাঁ বাড়িতে ঠাকুরদালান তৈরি হয়েছিল। যদিও আর পাঁচটা সাধারণ ঠাকুরদালানের চেয়ে সেটি ছিল খানিক আলাদা। উপবৃত্তাকার উঠোনের এক পাশেই ছিল দুই দালান বিশিষ্ট ঠাকুরদালান। অন্দরের দালানটি তিনটি খিলানে বিভক্ত। যার সামনের দালানটি নাটকের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হত। সেখানেই নাটক, যাত্রা মঞ্চস্থ হত। ঠাকুরদালানের সোজাসুজি সদর দরজা থাকত। সেখান দিয়ে ঢুকেই দোতলার বারন্দায় ওঠার সিঁড়ি থাকত। বারন্দার সামনের অংশগুলি অনেকটা প্রাচীন ইউরোপীয় অপেরা হাউসের ব্যালকনির ধাঁচে গড়া অর্ধবৃত্তাকার।
 
রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজো করা হয়। আগে এক সময় শাল কাঠ দিয়ে দেবীর কাঠামো তৈরি হত। যদিও এখন গরান কাঠ দিয়ে তা বানানো হয়। জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামোতে দেবীর মস্তক স্থাপন করা হয়। অন্য দেবদেবীর মস্তক স্থাপন হয় পরে। পটুয়ারা দেবীর চালচিত্র তৈরি করেন। মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদে থেকে এই বাড়ির পুজো আরম্ভ হয়, দেবীর বোধন হয়। দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠার সময় তেরোটি শাড়ি ও তেরোটি কাঁসার পাত্র দেওয়া হয়। এছাড়াও একশো আটটি পেতলের প্রদীপ সাজানো হয়। দাঁ বাড়ি বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত বলে, এখানে পশুবলি হয় না। বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত বলেই এ বাড়ির প্রতিমার সঙ্গে আধুনিক রূপের সাদা সিংহের দেখা মেলে। অব্রাহ্মণ পরিবার হওয়ায় দাঁ বাড়িত অন্নভোগের চল নেই। চাল, ডাল, বিভিন্ন ফল ও নিষ্টান্ন নৈবেদ্য রূপে অর্পণ করা হয়। এই বাড়ির পুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল কলাবউয়ের ছাতা। সপ্তমীর দিন ভোরে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে শোভাযাত্রাসহ বিরাটা এক কারুকার্যখচিত ছাতায় ঢেকে গঙ্গায় নবপত্রিকাকে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হয়। আগেকার দিনে কলকাতার বনেদি পরিবারগুলিতে গৃহদেবতাদের স্থানান্তরের সময় ছাতা ব্যবহার করা হত। ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হত সে সব ছাতা। ঢাকা বা বারাণসী থেকে আসা দক্ষ কারিগরেরা সেই ছাতার উপরে সরু সোনা ও রুপোর তার দিয়ে নকশা তৈরি করতেন। দাঁ-বাড়িতে এখনও সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকাকে স্নান করাতে যাবার সময়ে সেই রকম ভেলভেটের উপরে সোনা-রুপোর তারের কাজ করা বড় ছাতা ব্যবহার করা হয়। সন্ধিপুজোয় এক বিশেষ রীতি রয়েছে। এবাড়ির পুজোয় নারীরা থাকেন নেপথ্য। সন্ধিপুজোর সমস্ত কাজ পরিচালনা করেন বাড়ির পুরুষেরা, বাড়ির ছেলেরা, জামাইয়েররা সকলে মিলে। অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো হয়। আগে নবমীর দিন এই বাড়ির ঠাকুরদালানের সামনে বা বৈঠকখানার ঘরে গানবাজনার আসর বসত। পুজোর সময় নাটক ও যাত্রা হত। দোতলার বারান্দা থেকে মেয়েরা অনুষ্ঠান দেখতেন। দাঁ পরিবারের কীর্তিচন্দ্র দাঁ-এর আমলে রথের সময় চিৎপুরের যাত্রাপালাগুলির মহরত হত এই বাড়িতে। তারপর বিভিন্ন জায়গার বায়না শুরু হত। সে সব আজ কেবলই স্মৃতি।
 
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে দাঁ বাড়ির মারাত্মক পর্যায়ে রেষারেষি ছিল। জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বললেও ভুল হয় না। দশমীর দিনের এক বহুল প্রচলিত গল্প রয়েছে। প্রতিমা বিসর্জনের সময় ৪০ জন বাহক দেবীকে নিরঞ্জনের জন্যে গঙ্গার ঘাটের কাছে নিয়ে যেতেন। বাহকদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হত, তারা যেন দেবীকে কাঁধে করে বিসর্জন দিতে নিয়ে যাওয়ার সময় ঠাকুরবাড়ির সামনে দেবীকে বেশ কয়েকবার ঘুরিয়ে নেন। কড়া ভাষায় আদেশ দেওয়া থাকত। কেউ কেউ বলেন সাত বার ঘোরানোর কথা বলা হত। সঙ্গে চলত ঢাক-ঢোল, বাজনা বাদ্যি। আদপে ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের ঈর্ষা উদ্রেক করতেই এমন নির্দেশ দেওয়া হত। তবে এখন সেই সব চুকে গিয়েছে। লরিতে করেই দেবী নিরঞ্জনে যান। তবে আজও পুজো হয়ে চলেছে ​​জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁর বাড়িতে। ইতিহাস, ঐতিহ্যের মিশেলে এই বাড়ির পুজোর আর কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো আজ সমার্থক হয়ে উঠেছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...