মহারাষ্ট্রের ওসমানাবাদ জেলার তুলজাপুর হল ইতিহাসখ্যাত শাক্ততীর্থ। একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এক পীঠমন্দির রয়েছে এখানে। এই পীঠের দেবীর নাম ‘ভবানী’, তবে দেবীর নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে স্থাননামও; তাই দেবী সকলের কাছে ‘তুলজা ভবানী’ নামেই প্রসিদ্ধা। এছাড়া ভক্তজন তাঁকে ‘তুরজামাতা’, ‘ত্বরিতামাতা’ ও ‘অম্বামাতা’ নামেও সম্বোধন করেন। তুলজাপুরের বালাঘাট পাহাড়ের বিস্তৃত এক ধাপে এই দেবীর সুদৃশ্য মন্দিরটি অবস্থিত। দেবীর ভৈরব হিসেবে রয়েছেন মহাদেব। এখানে তাঁর নাম, ‘কালভৈরব’। বালাঘাট পাহাড়েরই শিখরে শ্যামল বৃক্ষমালার ছায়ায় তাঁর পৃথক মন্দির রয়েছে। কিংবদন্তি অনুসারে, মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে চারটি সতীপীঠের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়। এই চারটি পীঠ হল, তুলজাপুরের ‘তুলজা ভবানী মন্দির’, কোলাপুরের ‘মহালক্ষ্মী মন্দির’, মোহরের ‘রেণুকা মন্দির’ এবং নাসিকের নান্দুরি গ্রামের ‘সপ্তশৃঙ্গী দেবী মন্দির’। এদের মধ্যে তিনটিকে পূর্ণপীঠ এবং একটিকে উপপীঠ হিসেবে ধরা হয়। তাই এই চারটি পীঠকে একত্রে ‘সাড়ে তিন শক্তিপীঠ’ বলা হয়। তুলজাপুরের শক্তিপীঠ বা সতীপীঠে দেবী সতীর কোন অঙ্গ পতিত হয়েছিল তা জানা যায় না। তবে, এখানে দেবীর জাগ্রত পীঠটি কীভাবে গড়ে উঠল তার পেছনে একটি পৌরাণিক উপাখ্যান পাওয়া যায়।
উপাখ্যানটি রয়েছে ‘স্কন্দ পুরাণ’-এ। তাতে বলা হয়েছে যে, পৌরাণিককালে কর্দম নামে এক ঋষি ছিলেন। তিনি তেমন বৃদ্ধ ছিলেন না, তবুও হঠাৎ-ই একদিন শিশুপুত্র ও স্ত্রীকে রেখে তিনি মারা গেলেন। এভাবে সহসা স্বামীকে হারিয়ে শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে তাঁর পত্নী অনুভূতি তখন দারুণ আতান্তরে পড়লেন। তাঁকে রক্ষা করে, তাঁর শিশুপুত্রের সুরক্ষার ভার নেয় এমন কেউ আত্মীয় বা স্বজন তাঁর ছিলেন না। কাজেই অনুভূতি দারুণ কাতর হয়ে আশ্রয় চেয়ে মাতা ভবানীর শরণাপন্ন হলেন। কেননা, ভবানীই জগন্মাতা। তিনি যুগে যুগে নানান রূপে দুরাচারীদের অত্যাচার থেকে ত্রিলোকের অসহায় সন্তানদের রক্ষা করেছেন, তাদের আশ্রয় দিয়েছেন, প্রতিপালন করেছেন।
জগন্মাতা ভবানীর শরণ নিয়ে অনুভূতি সংকল্প করলেন যে, দেবীকে তপে তুষ্ট করে তিনি তাঁর কৃপা অর্জন করবেন। যেমন সংকল্প, তেমন কাজ। অমনি মান্দাকিনীর পুণ্যজলে অবগাহন করে নদীর তীরেই সম্মুখে শিশুসন্তানকে রেখে অনুভূতি এক দারুণ তপস্যায় মগ্ন হলেন। দিনের পর দিন চলতে লাগল তাঁর কঠোর সাধনা। তারই মাঝে একদিন কুকুর নামে এক দানব অপরূপা তপস্বিনী অনুভূতির রূপে মুগ্ধ হল। প্রথমেই সে অনুভূতির তপস্যাভঙ্গ করতে এল। এল তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দিতে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই সে তপস্যা ভঙ্গ করতে পারল না। তখন দারুণ ক্রুদ্ধ হয়ে অনুভূতির অসহায় শিশুপুত্রের ক্ষতি করতে উদ্যত হল। এমতাবস্থায় দেবী কিন্তু আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি অমনি তপস্যাস্থলে আবির্ভূত হয়ে দানবকে বধ করে শিশুপুত্রকে রক্ষা করলেন এবং অনুভূতিকেও কৃপা করে তাঁর প্রার্থনা পূরণ করলেন। এরপর অনুভূতির প্রার্থনাতে তুষ্ট দেবী আরও একটি কৃপা প্রদর্শন করলেন। জগতের সমস্ত সন্তানদের আশ্রয় দান করতে তুলজাপুরে মূর্তিরূপে অধিষ্ঠিত হয়ে রইলেন। এই কাহিনির প্রেক্ষিতেই অনেকে দেবীমূর্তিটিকে ‘স্বয়ম্ভূ’ অর্থাৎ নিজে থেকেই স্রিস্ট—এ-কথা বলে থাকেন।
যাই হোক, দেবীমূর্তিটি কিন্তু কালো পাথরে নির্মিত। কিছু ভক্তজনের মতে নির্মাণের সময় এই পাথর পবিত্র বিষ্ণুশিলাময় গণ্ডকী নদী থেকে আহরণ করা হয়েছিল। দেবীমূর্তির উচ্চতা আড়াই থেকে তিন ফুট। দেবী অষ্টভুজা। হস্তসমূহে রয়েছে আয়ুধ এবং বরাভয়। অখণ্ড একটি পাথর খোদাই করেই দেবীর আপাদমস্তক মূর্তি নির্মিত হয়েছে, ঐ পাথরেই নির্মিত হয়েছে সাদামাঠা চালচিত্রও। চালচিত্র অলঙ্করণহীন হলেও দেবীর মূর্তি কিন্তু সাদামাঠা নয়। মাথার ওপর খোদাই করা হয়েছে পাথরের লম্বা মুকুট, নাক-কানের অলঙ্কার, বস্ত্র, অঙ্গের সমস্ত আভরণ এবং অস্ত্রসমূহ। দেবীর মুখমণ্ডল স্নিগ্ধ ও অপূর্ব লাবণ্যময়। দেবীর নিত্য অভিষেক হয় পঞ্চামৃত দিয়ে। তারপর তাঁর প্রস্তর মুকুট ও অলঙ্কারের ওপর সোনার মুকুট ও সোনার অলঙ্কার পরানো হয়। পাথরের বসনের ওপর পরানো হয় নানান রঙের তাঁতবস্ত্র, উড়ুনি প্রভৃতি। গলায় নানাবিধ রত্নময় সোনার হারের সঙ্গে ফুল ও লেবুর হার পরানো হয়। কপাল থেকে দুই গাল অব্দি লেপন করা হয় হলুদ-চন্দনের প্রলেপ। কপালের মধ্যিখানে দেওয়া হয় বৃহৎ সিঁদুরের ফোঁটা। দেবীর দুই নয়নে স্থাপন করা হয় সোনার নয়ন। পদতলে রাখা হয় রত্নময় দুটি পাদুকা। দেবী এভাবে সুসজ্জিতা হয়ে রুপোর সুদৃশ্য ছত্রময় বেদিতে অবস্থান করেন।
গর্ভগৃহের পাশে রয়েছে দেবীর শয়নকক্ষ। সেখানে রয়েছে রত্নময় সজ্জা। বছরে তিনবার বিশেষ বিশেষ তিথিতে দেবী এই সজ্জায় শয়ন করেন। শয়নের জন্য দেবীর কোন ছলনমূর্তি ব্যবহৃত হয় না, আসল মূর্তিটি বেদি থেকে সামান্য আয়াসেই তোলা ও সরানো যায়।
দেবীমন্দিরের অন্যতম আকর্ষণের বস্তু কুমড়ো আকৃতির একটি পাথর। এই পাথরের নাম ‘চিন্তামণি’। শোনা যায়, এই পাথরের ওপর কয়েন রেখে পাথরের দু-পাশে হাত রেখে মনে মনে কোন প্রশ্ন করলে এই পাথর নাকি ডান বা বামদিকে নড়ে সম্মতি বা অসম্মতি জানায়। আরও শোনা যায়, স্বয়ং ছত্রপতি শিবাজী আপন মনের অনেক দ্বন্দ্ব এভাবেই এই পাথরে হাত রেখে নিরসন করতেন। বলা বাহুল্য, পাথর নড়ার ব্যাপারটার কোন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয়নি, ফলে এর পিছনে কোন বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তও নেই, মিথের মূলে আছে নিতান্তই ভক্তজনের বিশ্বাস।
যাই হোক, দেবী কিন্তু মহারাষ্ট্রের সুবিখ্যাত ভোঁসলে রাজবংশের কুলদেবী। এই রাজবংশেই জন্ম নিয়েছিলেন মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ইতিহাসখ্যাত রাজা ছত্রপতি শিবাজী। বালা বাহুল্য, তিনি নিয়মিত এই মন্দিরে দেবীর পূজায় অংশ নিতেন, দেবীর কৃপাপ্রার্থী হয়ে পূজা নিবেদন করতেন। কিংবদন্তি অনুসারে জানা যায় যে, দেবীর কৃপায় নাকি তিনি এক অপরাজেয় তলোয়ার লাভ করেছিলেন; সেই তলোয়ারের নাম ছিল, ‘ভবানী তলোয়ার’।
দেবীর মন্দিরটি অনেকটা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। পাথরের বিশাল ফটক, এই ফটক দিয়েই বাহির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হয়। চারিদিকে পাথরের প্রাকার। মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমেই ফ্রি কুপন নিতে হয় কাউন্টার থেকে। আর এটা নেওয়ার সময়ই নিরাপত্তাকর্মীরা প্রবেশপ্রার্থীর ছবি তুলে রাখেন ক্যামেরায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বজায় রাখার স্বার্থে। পাশ নেওয়ার পরই ‘গোমুখ তীর্থ’ নামের প্রবাহিত জলের কুণ্ডে হাত-পা ধুয়ে দেবীদর্শনের জন্য অগ্রসর হতে হয়। কিংবদন্তি অনুসারে ব্রহ্মার কৃপায় এই কুণ্ডে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী এই তিন পবিত্র নদীর ধারা একত্রে প্রবাহিত হয়। এই কুণ্ডে পবিত্র হয়ে প্রথমে গণপতিকে দর্শন করে তারপর কিছুটা উঁচু-নীচু গলি রাস্তা পেরিয়ে তবেই দেবী ভবানীর দর্শন পাওয়া যায়।
দেবীর গর্ভগৃহের প্রাঙ্গণ প্রবেশদ্বার, থাম সমস্তই অপূর্ব সুন্দর অলঙ্কৃত রুপোর পাতে মোড়া। মন্দিরটির প্রাকার-প্রাঙ্গণের নির্মিতি যেন দুর্গের মতো। যাই হোক, কয়েকশো বছরের প্রাচীন এই মন্দিরের প্রস্তরময় অপূর্ব নির্মাণ তীর্থকামী মানুষের মনে অভূতপূর্ব এক ভাবের জন্ম দেয়। মঙ্গলবারটিকে দেবী ভবানীর বার হিসেবে ভক্তজন সম্মান দেন। তাই এই বারে মন্দিরে ভক্তদের দারুণ ভিড় হয়। তবে মন্দিরে ভিড়নিয়ন্ত্রণের ভালো ব্যবস্থা আছে। মঙ্গলবারে দর্শনের জন্য লাইন দিয়ে ঘন্টাদুয়ের মধ্যে দর্শন হয়ে যায়, সাধারণ দিনে এক ঘণ্টা লাগে। প্রতি মঙ্গলবার ছাড়াও ‘ভবানী অষ্টমী’ বা ‘ভবানী জয়ন্তী’, চৈত্র মাসের ‘নবরাত্রি, ‘মকর সংক্রান্তি’, ‘রথসপ্তমী’, ‘ললিতা পঞ্চমী’—প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ তিথিপুজোয় ও উৎসবে এই মন্দিরে কিন্তু তিলধারণের স্থান থাকে না।।...