বাঙালি কালী পাগল জাতি। শক্তির দেবীর সঙ্গে এই জাতির নাড়ির টান। তাদের সুখে ‘মা’, দুখে ‘মা’। এই ‘মা’ আসলে মা কালী। দেবী কখনও আনন্দময়ী কখনও করালবদনি। কালিকার উৎসব সামনে এলেই মনে পড়ে যায় এই পুজোর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত কয়েকটি নাম। মায়ের নামে কাতর হয়েছিল তারা। বাংলার জলমাটির সন্তানরা তাদের ডাকে ভেসেছিল ভাবসাগরে। সে যেন মায়ের কাছে কোলের সন্তান। তার বয়স বাড়ে না। সমাজ-সংসার-জায়া-পুত্র-পরিবার সব বৃথা হয়ে যায়। শুধু মা আর সন্তানের অবিচ্ছেদ্য টান। এমনই এক নাম বামাক্ষ্যাপা। দেবী কালিকার উৎসবে বাঙালি ভুলতে পারে না সেই সাধকের কথা।লোকমুখে বামাক্ষ্যাপা ‘তারা মায়ের ছেলে’।
দ্বারকানদীর তীরে ই. আই রেলের লুপলাইনে অবস্থিত তারাপুর। কাছেই মল্লারপুর স্টেশন। তারাপুরের আটলাগ্রামে জন্ম হয় বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের। বর্তমানে বীরভূম জেলার অন্তর্গত। পিতা সর্ব্বানন্দ চট্টোপাধ্যায়। সর্ব্বানন্দ ছিলেন পরম ধার্মিক মানুষ। আটলা গ্রামে তাঁর মতো নিষ্ঠাবান মানুষ আর কেউ ছিল না। দুই পুত্র চার কন্যা (মতান্তরে চারটি) নিয়ে সংসার। জ্যেষ্ঠ বামাচরণ। কনিষ্ঠ রামচন্দ্র।
বামাচরণ বাবার ধাত পেয়েছিল। ছোট থেকেই ধর্মপ্রাণ। পুজোপাঠ দেবদেবীতে মতি। পড়াশোনা তার মোটে ভাল লাগে না। দিনকাটে খেলাধূলায়। তবে গ্রামের বাকি বালকদের থেকে বামার খেলার ধরন ছিল আলাদা। সে নিজে হাতে কালীমূর্তি গড়ত। ফুল দিয়ে সাজাতো তার খেলার ঠাকুরঘর। জগদ্ধাত্রী মূর্তি, শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা সব তার নিজের হাতে শরীর পেত। এ ভিন্ন তাকে কখনও অন্য খেলায় দেখা যায়নি।
বাবা কখনও বাধা দিতেন না তাকে। ছেলের নিষ্ঠা তাঁকে মুগ্ধ করত। তাই প্রথামাফিক পাঠাঙ্গনে বামাকে দেখা যায়নি। কিন্তু সুসময় বড় ক্ষণস্থায়ী। জীবনের শুরুতেই পিতৃহারা হত হল তাকে।
কর্তার মৃত্যুতে অথৈ জলে পুরো পরিবার। ছোট ভাই রামচন্দ্র তখনও শিশু। মা বামাকে বললেন চাকরি খুঁজতে। কিন্তু স্বভাব উদাস বামা ছোটবেলায় পাঠশালায় তেমন যাননি, বৈরাগী মন নিয়ে তাঁকে সংসারের আবর্তের ঘূর্ণিপাকে পড়তে হল। মা তাঁকে বলেছিলেন, ‘কাজ দ্যাখো, না হলে যে অনাহারে মৃত্যু ভবিতব্য’ মায়ের সেই করুণ কণ্ঠ কিছুতেই ভুলতে পারলেন না। কেবল ভাবতে লাগলেন বিশ্বেশ্বরীর সংসারে কেউ তো অনাহারে মরে না, জীবন যখন জঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই মাতৃস্তনে দুধের সঞ্চার হয় তাহলে সেই ভুবনে সত্যি সত্যি অনাহারে আমাদের মৃত্যু হবে!
সংসার ভাবনায় কুলকিনারা না পেয়ে বামাচরণ মাঝে মাঝে সন্নিকটস্থ তারাপীঠে তারা মায়ের মন্দিরে এসে বসে থাকতেন। ছেলের মতি দেখে বামার মা বলেছিলেন অন্য কাজের দরকার নেই, বাড়িতে থেকে চাষবাস করো, তাতেই হয়ে যাবে আমাদের দিন গুজরান। কিন্তু বিবাগী মনের ছেলেকে বেশীদিন ঘরে রাখতে পারেননি। বারো বছর বয়সে গৃহত্যাগী হলেন বামা।
তারাপীঠে থাকতেন কৈলাশপতি বাবা, তাঁর শিষ্য হলেন। বামা তখনও ‘ক্ষ্যাপা’ নাম পাননি। দ্বারকা নদীর তীরে যোগ ও তন্ত্র সাধনা শুরু করলেন। পরে মালুটি গ্রামে যান। সেখানে সেখানে দ্বারকার তীরে মৌলাক্ষী দেবীর মন্দিরে সাধনাকালে প্রায় ১৮ মাস অবস্থান করেন।
তারামায়ের পাদপদ্মে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘরে তখন জননী বর্তমান বলে মাঝে মাঝে গৃহে আসতেন। তারাপীঠের অধিপতি মোক্ষদানন্দ ভক্তির টান দেখে তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বামাই ছিল তাঁর প্রধান চ্যালা। মোক্ষদানন্দের মৃত্যুর পর তারাপীঠের মোহন্ত হিসেবে সিদ্ধপীঠে অধিষ্ঠিত হন। তারামায়ের জন্য সারাক্ষ্ণ মা মা ডাকে কাতর হলেও নিজের জন্মদাত্রীর থেকে কখনও দূরে জাননি তিনি, কিন্তু আপন মাতৃবিয়োগের কথা তিনি জানতে পারেননি।
শোনা যায় নদীতে স্নান করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন মায়ের মহাপ্রস্থানের কথা। নদীর জলে আপন মনে স্নান করছেন এমন সময় কানে এলো দূর থেকে ভেসে আসা হরির ধ্বনি। পরে দেখলেন সেই ধ্বনি তাঁর মায়ের। তাঁর জননীর দেহ শ্মশানে আনা হয়েছে অন্তিম কাজের জন্য। বামাচরণ দেখেই বুঝতে পারলেন ঘটনা। ‘মা মা’ বলে কেঁদে আকুল হলেন। বামার কান্না শোকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল বাকিদেরও।
দাহকার্য্যের প্রস্তুতি শুরু হল। বামাচরণের ইচ্ছে যে নদীর তীরে তারামায়ের মূর্তি আছে সেই পারের শ্মশানেই তাঁর জন্মদাত্রীর শেষ কাজ সমাধা হোক। কিন্তু নদীতে তখন বান ডেকেছে। স্রোত এত প্রবল যে পার হওয়া যায় না। বামা বুঝলেন ইচ্ছেপূরণের কোনও সম্ভাবনাই আর নেই। উঃপায় না দেখে খরস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন বামা। আর মুখে তাঁর তারা নাম। বলতে লাগলেন, “মা তারা, আমার মা যেন তোর তীরে স্নান পায় মা...”
তথ্য সূত্রঃ (বামাক্ষেপা-যোগীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়)