পূজা দু'রকমের। নিত্যপূজো ও কাম্যপূজো। যে পুজো না-করলে শাস্ত্র মতে পাপ হয়, সেই পুজোকে বলা হয়, নিত্যপূজো। দেবী কালীর পুজোর উদাহরণ দিয়েই ব্যাপারটা আসুন স্পষ্ট করি :
কার্তিক মাসে অমাবস্যা তিথিতে শ্যামা বা দক্ষিণা কালীর যে পুজো করা হয়, তা হচ্ছে নিত্যপূজো।
আবার কার্তিক ছাড়া অন্যান্য মাসে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য বা বিশেষ কামনাপূরণের জন্য দেবীর যে পুজো করা হয়, তাকে বলে কাম্যপূজো। এই যেমন ধরুন, মাসে মাসে শনি বা মঙ্গল বারের সন্ধ্যেবেলায় অষ্টমী-নবমী-চতুর্দশী-অমাবস্যার মধ্যে যে-কোন একটি তিথিতে যে রক্ষাকালীর পুজো করা হয়, তা কাম্যপূজো। এছাড়া জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যায় যে ফলহারিণী কালীপুজো করা হয় এবং মাঘ মাসের (চান্দ্র মাসের হিসেবে কখনও বা পৌষ মাসের) কৃষ্ণচতুর্দশীতে যে রটন্তী কালীর পুজো করা হয়, তাও কাম্যপূজো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কাম্যপুজোর কালীদের 'রক্ষা', 'ফলহারিণী', 'রটন্তী'-এসব নামকরণের কারণটা কী? আসলে, নামের ভেতর লুকিয়ে আছে পুজোর উদ্দেশ্য। তাই মহামারী-দুর্ভিক্ষ এবং সমস্ত রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার প্রার্থনা নিয়ে যে কালীর পুজো করা হয়, তিনি হলেন 'রক্ষাকালী'।
পাপের ফল হরণ করার প্রার্থনা জানিয়ে যে কালীর পুজো করা হয়, তিনি 'ফলহারিণী কালী'। মাঘ মাসের কৃষ্ণচতুর্দশী তিথিকে বলা হয়, রটন্তী চতুর্দশী। তাই এই তিথিতে যে কালীর পুজো হয়, তিথি অনুসারে তাঁর নাম হয়েছে 'রটন্তী কালী'। তিথির নামেই লুকিয়ে আছে পুজোর উদ্দেশ্য। 'রটনা' থেকে 'রটন্তী'। রটনা বা অপবাদ নাশের প্রার্থনা জানিয়ে রাত্রির সূচনায় বা মধ্য রাত্রে এই দেবীর পুজো করা হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিথির নাম 'রটন্তী' হল কেন? আর এই তিথিতে কালী পুজোর প্রচলনই বা হল কী করে? উত্তর আছে পুরাণ ও প্রবাদ মিলে গড়ে ওঠা একটি গল্পের মধ্যে, সেটাই এবার বলছি :
'ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ'-এর গল্পে রাধাকৃষ্ণ প্রেমিক-প্রেমিকা। কিন্তু, বাড়ি থেকে রাধার বিয়ে ঠিক করা হল শ্রীকৃষ্ণের আপন মামা আয়ানের সঙ্গে। তখন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধা গোপনে দেখা করে অনুরোধ করলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ যেভাবেই হোক তাঁকে যেন বিয়ে করেন, নইলে তিনি কিন্তু আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন।
কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বললেন যে, পূর্ব অভিশাপের কারণে এ-জন্মে তাঁরা বিয়ে করে স্বামীস্ত্রী হতে পারবেন না। তবে চিন্তা নেই, আয়ানের সঙ্গে বিয়ে হলেও আয়ান রাধার সঙ্গে স্বামীর মতো আচরণ করতে পারবেন না। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে কৌশলে নপুংসক করে দেবেন। এবং, নিজে রাধার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখবেন।
কথা মতো রাধার সঙ্গে আয়ানের বিয়ে হল। বিয়ের রাতেই শ্রীকৃষ্ণ আয়ানকে নপুংসক করে দিলেন। এবং, দেবী কাত্যায়নীর পুজো করতে যাওয়ার অছিলায় রাধা গোপনে নিয়মিত কুঞ্জবনে গিয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হতে লাগলেন। স্বামী সহবাস করলে নারীর শরীরে যে যে পরিবর্তন হয়, রাধার শরীরে সেই সেই পরিবর্তন দেখে একদিন শাশুড়ি জটিলার সন্দেহ হল।
তাই ছেলে আয়ানকে সঙ্গে নিয়ে রাধাকে হাতেনাতে ধরতে খুঁজতে খুঁজতে কুঞ্জবনে হাজির হলেন। রাধা ও শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের আসতে দেখে কালীরূপ ধারণ করলেন। সেই কালীরূপে চারটি হাত দেখা গেল। এক হাতে বরাভয়, দু'হাতে বাঁশি, আর এক হাতে খড়্গ। গলায় বনমালা। রাধা শুরু করলেন পুজো। আয়ান ও জটিলা কুঞ্জে এসে দেখলেন রাধা সত্যিই দেবীপূজায় মগ্ন। তখন তাঁরা তুষ্ট হয়ে ফিরে গেলেন এবং রাধাও কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচলেন।
মান্য-পুরাণের গল্প এখানেই শেষ। এর সঙ্গে লোকপুরাণ বা লোকশ্রুতি জুড়ে তৈরি হয়েছে রটন্তী কালীপুজোর ইতিহাস। সেই লোকশ্রুতিতে বলা হচ্ছে যে, যে-দিন রাধা 'রটনা' বা অপবাদ বা কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচার জন্য কালীরূপধারী শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ কৃষ্ণকালীর পুজো করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন, সেদিন ছিল মাঘ মাসের কৃষ্ণচতুর্দশী তিথি।
'রটনা' শব্দ থেকে 'রটন্তী' বিশেষণ গড়ে মাঘ মাসের কৃষ্ণচতুর্দশীকে তাই এরপর থেকে ডাকা হতে লাগল 'রটন্তী চতুর্দশী' বলে। আর এই তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ ও কালীর মিশ্ররূপে যে নতুন বিগ্রহপুজোর সূচনা রাধার হাতে হল, তাও লোকসমাজে ব্যাপকভাবে গৃহীত হল। তিথির নামে দেবীও পেলেন নতুন নাম, 'রটন্তী কালী'। নামে যেন বোঝানো হতে লাগল যে, এই দেবী 'রটনা' অর্থাৎ কলঙ্কনাশিনী দেবী। রাধার প্রেম-কলঙ্ক ভঞ্জনের প্রার্থনা আপামর মানুষের কাছে সামাজিক যে-কোন রকমের অপবাদ-নিন্দা-কলঙ্ক থেকে দূরে রাখার প্রার্থনা হয়ে উঠল।
রটন্তী চতুর্দশীতে কালী পুজো করার কথা বলা হয়েছে 'মায়াতন্ত্র', 'উত্তরকামাখ্যাতন্ত্র', 'হরতত্ত্বদীধিতিধৃত' প্রভৃতি মধ্যযুগে রচিত তন্ত্রগ্রন্থসমূহে। এসব সংস্কৃতগ্রন্থ। তবে রটন্তী চতুর্দশীতে বাংলায় যে এই শ্যাম ও শ্যামার সম্মিলিত কালীরূপের উপাসনা করা হয়, বাংলা ভাষায় তার প্রথম বন্দনাটি কিন্তু গেয়েছিলেন কবি-সাধক রামপ্রসাদ সেন :
"তেমনি তেমনি তেমনি করে নাচ দেখি মা!
ব্রজে যেমন নেচেছিলে হয়ে বনমালী--
অসি ছেড়ে বাঁশী লয়ে,
মুণ্ডমালা ছেড়ে বনমালা ধরে,
তেমনি করে নাচ দেখি মা!"
তথ্যঋণ:
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ- বেদব্যাস
শ্রী শ্রী কালীপূজা- পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়
দেবদেবীতত্ত্ব- সতীশচন্দ্র শীল