শিবাজীর মত্যুর পর মারাঠারাজ্যের সিংহাসন অধিকার করেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র শম্ভাজী। কিন্তু মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে মারাঠারা পেরে ওঠেনি। শম্ভাজিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব।
শম্ভাজির জীবনের এই শোচনীয় ও মর্মান্তিক পরিণতির পরে মুঘলদের সঙ্গে মারাঠাদের সন্ধির সম্ভাবনা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এরপর ঠিক করা হয় শম্ভাজির শিশুপুত্র মারাঠা রাজ্যের রাজা বলে বিবেচিত হবেন কিন্তু আপাতত তার জায়গায় শম্ভাজির ভাই রাজারাম শাসনকার্য এবং যুদ্ধবিগ্রহ দেখাশোনা করবেন।
মারাঠারা রাজারামের নেতৃত্বে ঔরঙ্গজেবকে আক্রমণ করে। ঔরঙ্গজেব অন্যস্থানে ঘুমিয়েছিলেন তাই বেঁচে যান। কিন্তু মুঘল সম্রাটদের ভেতর ভয় ঢোকাতে পেরেছিলেন মারাঠারা।
কিন্তু অন্য একটা বিপত্তি নেমে আসে। মুঘলবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে। রায়গড়ের পতন হয়। রায়গড় দুর্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শম্ভাজির পত্নী ও ন’বছরের সন্তান সাহু ধৃত হয়েছিলেন। যুদ্ধ বাঁধে মুঘল ও মারাঠাদের মধ্যে।
এই পরিস্থিতিতে মারাঠারা শিবাজীর আদর্শকে সামনে রেখে স্বদেশের জন্য জীবন পণ করে অতুলনীয় পরাক্রমে যুদ্ধ করতে থাকে। যুদ্ধের প্রথম ক্ষেত্রে মারাঠাদের অবস্থা ভালো ছিল না। রাজারামের ক্ষতি হয় বিস্তর। রাজারাম যুদ্ধের ক্ষেত্রে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তবে মুঘলদের ভিত নাড়িয়ে দিতে পেরেছিল মারাঠারা। সম্রাট ঔরঙ্গজেব নিজেও মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধি করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু সেই সময় উপায় ছিল না। তাই যুদ্ধের পথেই হাঁটছিলেন সকলে। দুপক্ষে আবার যুদ্ধ হয়।
১৭০০ সালে বেরার অভিযানের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে রাজারাম অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর এক ছেলেকে রাজা বলে ঘোষণা করা হয়, কিন্তু তিন সপ্তাহ রাজত্বের পর তিনি বসন্ত রোগে মারা যান। এই সময়ই মহারাষ্ট্রের রাজনীতির ক্ষেত্রে রাজারামের প্রধান স্ত্রী তারাবাঈ-এর আবির্ভাব হয়।
রাজারাম যখন রায়গড়-এর দুর্গে বন্দী ছিলেন সেই সময় তাঁর স্ত্রী তারাবাঈ এবং সপত্নী রাজসবাঈ দুর্গের মধ্যেই ছিলেন। অনেক সেবা করেও বাঁচানো যায়নি রাজারামকে।
মারাঠ া দের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তারাবাঈ। নিজের নাবালক সন্তানকে সামনে রেখে তিনি মারাঠাদের উন্নতির জন্য যুদ্ধ শুরু করেন। রাজারামের অন্য এক স্ত্রী রাজসবাই এই ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তারাবাঈ সেই বাধা ভেঙে মারাঠাদের হৃদয় জয় করেছিলেন। তাঁর ন‘বছরের পুত্রের নাম ছিল শিবাজী। পুত্রকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করবার জন্য তিনি কঠিনতর মূর্তি ধারণ করেন। ছত্রপতি শিবাজী যে মারাঠা সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন তা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তারাবাঈ নিজের সন্তানের নাম রেখেছিলেন শিবাজী।
১৭০১ সালে তারাবাঈ-এর পুত্র দ্বিতীয় শিবাজীর অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এরপর তারাবাঈ নিজের মত করে রাজ্য চালাতে থাকেন।
অত্যন্ত বুদ্ধিমতী নারী ছিলেন এই তারাবাঈ। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মারাঠাদের জীবন থেকে ঔরঙ্গজেব নামক কাঁটা দূরে সরানো। তিনি ঔরঙ্গজেবের বশ্যতা স্বীকার করে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। যদিও সম্রাট ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের সমস্ত দুর্গ দাবি করায় প্রস্তাবটি এগোয়নি।
তবে এর মধ্যেই নিজের ব্যক্তিত্বের তেজে বলীয়ান হয়ে তারাবাঈ রাজত্ব চালিয়ে গেছেন। মহারাষ্ট্রের রাজার তিনি অভিভাবিকা এবং প্রজাদের কাছে তিনি ছিলেন একাধিনায়িকা। মারাঠা রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের ভার ছিল তাঁর হাতে।
তিনি নিজের হাতে রাজ্যের ক্ষমতা চেয়েছিলেন তবে সেই ক্ষমতার কখনো অপব্যবহার করেননি। নিজের রাজকার্য পরিচালনার ক্ষমতাকে তিনি সর্বদা ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করেছেন। সামরিক প্রতিভায় অদ্ভুত ছিলেন তারাবাঈ। বিভিন্ন দুর্গে বিরামহীন ভাবে ছোটাছুটি করতেন। সব দিকে নজর রাখতেন। কোন যুদ্ধ অভিযানের ক্ষেত্রে কর্মাধ্যক্ষ ও সেনা নায়কদের তিনি উৎসাহের কথা শোনাতেন এবং অভিযান পরিকল্পনায় তাদের যথেষ্ট সাহায্য করতেন।
তবে মারাঠাদের অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ সব সময়ই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারাবাঈ নিজের মতো করে চেষ্টা করেছিলেন মারাঠাদের অভ্যুত্থানের। কিন্তু বারবার পরিস্থিতি বা রাজনীতির শিকার হয়েছেন তিনি। তবুও নিজের ব্যক্তিত্বে বলিয়ান হয়ে তেজস্বিনী এই নারী শেষ দিন পর্যন্ত মারাঠা সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার চেষ্টা করে গেছেন। তাই মধ্যযুগীয় নারী হিসেবে তারাবাঈ নিজের নির্দিষ্ট স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।