খেল হ্যায় কাঠপুতলী কা!

তীক্ষ্ণ নাক। বাঁশপাতা চোখ। চুড়িতে ভরা দুই হাত। ঘাঘরার ঘেরে মূর্ছনা। যখন মঞ্চে আসে তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায় দর্শক। পাগড়ি মাথায় হাতে বিন। বাজিয়ে চলে সঙ্গী পুরুষটি।

 গানে-গল্পে তোলপাড় প্রতিটা মুহুর্তে। দর্শকদের নজর সরে না তাদের ওপর থেকে। সহজ কথা, নাটকীয় কাহিনি আর মেঠো সুরের আবেদন ঘোর জাগায়। সুতোয় বাঁধা জীবন। তবু রঙের কমতি নেই।

ওরা কাঠপুতলী। সুতোর টানে কথা বলে ওঠে। নাচে, গায়, গল্প বলে। আসলে নট-নটী। বিনোদনের খেলায় ওরাও রাজা-রানী।

ওদের গল্প জানতে হলে পাড়ি দিতে হবে মরুশহরে। উট, বালি, রঙ আর ইতিহাসের দেশে।  

রাজস্থানের নাগুড় জেলা। এই অঞ্চলকেই মূলত কাঠপুতুলের জন্মভূমি বলা যায়। ভাট আর নাট সম্প্রদায়ের মানুষরা কাঠপুতুল নাচের পেশার সঙ্গে যুক্ত। যাঁদের ডাকনাম ‘পুতুলওয়ালা’। কাঠপুতলী কলাকার। ‘কাঠপুতলী কা খেল’ দেখান। 

যাযাবরী রক্ত ওঁদের ধমনীতে। থর মরভূমির প্রান্তরে ঘুরে বেড়ান। গাঁ থেকে গাঁয়ে ছুটে চলা। সঙ্গে থাকে পরিবার। পরিবার মানে দল। হাজার বছরের ইতিহাসকে সঙ্গী করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই বয়ে চলে কাঠপুতুলের কুশীলবরা। পথ চলতে চলতে তৈরি হয় গল্প, গান, কাহিনির ঘের। রাজপুত ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখেন লোক সংস্কৃতির পরম্পরা। শুধু রাজস্থান নয়, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য ‘কাঠপুতলী খেল’।   

পুতুল নাটক দেখাতে রাজস্থান ছাড়াও উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পঞ্জাবেও ঘুরে বেড়ান এই সম্প্রদায়ের মানুষরা। নাটিকার গান এবং সংলাপের ভাষা হয় হিন্দি আর উর্দুতে। নিজেরাই গান লেখেন। পালা বাঁধেন। পুতুলও তৈরি করেন নিজেরাই। রাজস্থানি কাঠপুতুলি থিয়েটারে মূলত রাজস্থানী লোককথা, রাজপুতদের কাহিনি।

কাঠের শরীর। পুতুলের পা থাকে না। লম্বা ঘাঘরা বা কুর্তিতে ঢাকা থেকে শরীর। কোমরের অংশ থেকে একটি তার বা সুতো নেমে যায়। কখনও কখনও তারের সংখ্যার হেরফেরও হয়। নাচিয়ে পুতুলের নাম আনারকলি। এই পুতুলটি ৬ সুতোর।

কাঠপুতলীর ‘শো’তে পুতুল ছাড়াও অন্য চরিত্ররাও থাকে। ভোজবাজি চলে। যাদুকর থাকে। এমনি ‘সাপেরা’ মানে সাপুড়ের খেলাও চলে।

কাঠপুতলী দলের প্রধান প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন পুতুল শরীরে। বাঁশের ‘বলি’ তে কণ্ঠ দিয়ে পুতুলের মুখে বোল ফোটান। মঞ্চ আর দর্শকদের মধ্যে কথা চলে শিসের ভাষায়। মঞ্চের বাইরে বসেন প্রধান। দলের অন্য এক কুশীলব থাকেন কথকের ভূমিকায়। এই আসনে সাধারণত মহিলাদেরই দেখা যায়। পালার গান ও গল্প স্থানীয় ভাষায় দর্শকদের বোধগম্য করে বলে চলেন তাঁরা।

জড় পুতুল তখন আর নিষ্প্রাণ থাকে না। হয়ে ওঠে রক্তমাংসের। তারা হাসে, কাঁদে, রেগে ওঠে। কখনও বা যুদ্ধ করে। টগবগিয়ে ঘোড়া ছোটায়। প্রেমের ভাষায় কথাও কয়। এক্কেবারে জীবন্ত! তবে সবটাই সুতোর টানে।

অনেক সময় কাঠপুতলীর খেলা তাঁবুতে আয়োজন করা হয়ে থাকে। পুতুল নাচিয়ের দল গ্রামে গ্রামে ঘুরে তাঁবু ফেলেন। সেখানেই তাঁরা থাকেন। আবার সন্ধে হলে সেখানে খেলাও দেখান। সানাই, ঢোলক, রবাব থাকে সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে।

এখন কাঠপুতলীর ঐতিহ্য অনেকটাই ম্লান। অনেক দল বিদেশে বা বিভিন্ন রাজ্যে ‘পাপেট থিয়েটার দেখাতে যায় ঠিকই, কিন্তু তা খুবই কম। সরকারী সাহায্য যৎসামান্য। রুটি-রুজির কারণে পেশা বদল করেছে অনেকেই। পেটের টানে গান থামিয়ে অন্য ভুবনে ঠাঁই খুজে নিয়েছে শিল্পীরা। তবে তাতেও কাঠপুতলীর থেমে যায়নি খেলা...সফর  চলছেই।

 

 

   

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...