কলকাতা তথা বাংলার দুর্গা মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত মন্দির হল খিদিরপুরের পতিত পাবনী দুর্গা মন্দির। খিদিরপুর ট্রামডিপোর কাছে ভূ-কৈলাস রাজবাড়ির মধ্যে রয়েছে পতিতপাবনী দুর্গা মন্দির। খিদিরপুরের ভু-কৈলাসের কথা সকলেরই জানা। মহারাজা রায়বাহাদুর জয়নারায়ণ ঘোষাল ভূ কৈলাস রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠাতা। এই ভূ-কৈলাস নামটি সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন দেওয়া। আবার কেউ কেউ বলেন, সেকালের পন্ডিতেরা ভূ-কৈলাস নামকরণ করেছিলেন। সুরধুনী কাব্যে ভূ-কৈলাস রাজবাড়ির বর্ণনা দিয়েছিলেন দীনবন্ধু মিত্র, তিনি লিখেছিলেন, ভুবনে কৈলাস-শোভা ভূ-কৈলাস ধাম, সত্যের আলয় শুভ সত্য সব নাম। ভূ-কৈলাসে রয়েছে তিনটি মন্দির। জয়নারায়ণ ঘোষাল সেখানে শিবগঙ্গা নামে একটি পুকুর খনন করেন। তারপর ১৭৮১ সালে দুটি আটচালা শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কষ্টিপাথরের দুটি শিবলিঙ্গের নাম হল রক্তকমলেশ্বর এবং কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর। কলকাতার নিমতলার হাটখোলা দত্তবাড়ির দুর্গেশ্বর ছাড়া এত বড় শিবলিঙ্গ কলকাতার আর কোথাও নেই।
তার এক বছর পর ১৭৮২ সালে মহারাজা জয়নারায়ণ তাঁদের কূলদেবী মা পতিত পাবনীর একটি মন্দিরের তৈরি করে, দেবীকে গর্ভগৃহে স্থাপন করেন। ফাল্গুন মাসে মধু ত্রয়োদশী সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে তিনি পাতিত পাবনী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মন্দির খিদিরপুরের কালীবাগে অবস্থিত। এই মন্দিরটি বাংলার নিজস্ব দালান স্থাপত্য রীতিতে বানানো হয়েছিল। এইখানে মা দুর্গা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রুপ ধারন করেন। যেমন ঝুলনে দেবী হন শ্রীকৃষ্ণ, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন তিনি মা লক্ষ্মী রূপে পূজিত হন। বিভিন্ন পুজোয় দেবীকে নানা রূপে সাজানো হয়। অমাবস্যা, কালী পুজোর দিন তিনিই মা কালী রূপে পুজো পান। এই মন্দিরে মায়ের মূর্তি অষ্টধাতু নির্মিত। পৌরাণিক সিংহের উপর দেবী অধিষ্ঠিতা। মূল মন্দিরের চারিদিকে অন্য চারটি মন্দির রয়েছে, সেগুলি হল মকরবাহিনী গঙ্গা, পঞ্চানন দেব, জয় কাল ভৈরব, এবং রাজেশ্বর মহালিঙ্গ। কিংবদন্তি অনুসারে, পতিতপাবনীর রূপ দর্শন করে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন গেয়ে উঠেছিলেন, 'পতিতপাবনী পরা, পরামৃত ফলদায়িনী স্বয়ম্ভূশিরসি সদা সুখদায়িনী'।
গড়-গোবিন্দপুর অঞ্চলে জয়নারায়ণ ঘোষালের জন্ম, তিনিই ছিলেন খিদিরপুরের ঘোষাল পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। পলাশির যুদ্ধের পাঁচ বছর আগে, ১৭৫২ সালে কন্দর্প ঘোষাল হাওড়ার বাকসাড়া থেকে কলকাতার গোবিন্দপুর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। নবাবের চাকরির পাশাপাশি তিনি নুন ও অন্যান্য জিনিসের ব্যবসা করতেন। পলাশির যুদ্ধের পর ইংরেজরা নতুন ফোর্ট উইলিয়ম তৈরি করতে শুরু করে, সেই সময় পুনর্বাসনের জন্যে নতুন জমি পেয়ে কন্দর্প পরিবার খিদিরপুরে উঠে এসেছিল। কন্দর্পের তিন পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র ব্যবসা শুরু করেন। মেজো ছেলে গোকুলচন্দ্র ছিলেন সে যুগের কেউকেটা ব্যক্তি। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের কারণে কলকাতার যে ক্ষতি হয়েছিল, সেই ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্যে তৈরি কমিশনের সদস্য ছিলেন গোকুলচন্দ্র।
কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র জয়নারায়ণই এই রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। ইংরেজি, আরবি, ফারসিসহ অজস্র ভাষা জানার সুবাদে তিনি নবাব নাজিম মোবারকদ্দৌলর দরবারে চাকরি পান। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস তার কাজে খুশি হয়ে দিল্লির বাদশাহের দরবার থেকে তিন হাজারি মনসবদারি পাইয়ে দেন। সেই মনসবদারী প্রাপ্তির স্বীকৃতি স্বরূপ দেওয়া দুটো কামান আজও রাখা রয়েছে। পতিতপাবনী দুর্গার মন্দিরের কাছেই তা রাখা আছে। নুন, সোনা ও রত্নের ব্যবসা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করেছিলেন জয়নারায়ণ। তিনিই আদি বাসভবনের পাশে ১০৮ বিঘা জমি কিনে পরিখা সমেত প্রাসাদ নির্মাণ করেন, সেটিই এই ভূ-কৈলাস। সেই ভূ-কৈলাস রাজপরিবার আজ বহু ভাগে বিভক্ত। ঘোষাল পরিবার বর্তমানে প্রথম বাড়ি, মাঝের বাড়ি ও শেষের বাড়ি; এই তিন ভাগে ভাগ হয়ে রয়েছে।
তবে আজও রয়েছে অষ্টধাতুর হর-পার্বতী অর্থাৎ পতিতপাবন। ঘোষাল পরিবারের গৃহদেবতা সেই পতিতপাবনেরই মন্দির তৈরি করেছিলেন জয়নারায়ণ। আজও সেখানে পতিতপাবনী দেবী দুর্গা পূজিত হচ্ছেন। পতিতপাবনী দুর্গা মন্দিরের জন্যে ট্রাস্টও আছে।