কলকাতা, এই শহরের পরতে পরতে ঐতিহ্য। বহু ধর্মের মিলনক্ষেত্র হল কলকাতা। প্রায় সব ধর্মের উপাসনালয় রয়েছে এ শহরে। যেমন জৈনদের পরেশনাথ মন্দিরের দেখা মেলে এখানে। বদ্রিদাস মন্দির স্ট্রিট, মানিকতলায় রয়েছে এই মন্দির। মানিকতলা থেকে খানিক এগিয়েই গৌরীবাড়ির পথে পড়বে বদ্রীদাস মন্দির স্ট্রিট। সেখানেই রয়েছে, জৈন সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় পীঠস্থান পরেশনাথ মন্দির। ১৮৬৭ সালে রায় বাহাদুর বদ্রিদাস মুকিম নামের জনৈক মারোয়াড়ি শ্রীমল জৈন এই মন্দিরটি নির্মাণ করান। মন্দির প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে ছিলেন শ্রী কল্যাণসুরেশ্বরজী মহারাজ। তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড মাও বদ্রিদাসকে রায় বাহাদুর ও মুকীম সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন কালকাদাসের সন্তান। তারা শ্রীমল জৈন সম্প্রদায়ভুক্ত। তিনিই জৈন সিদ্ধপুরুষ কল্যাণসুরিজির নির্দেশে এই মন্দিরে স্থাপন করেন।
পরেশনাথ মন্দিরের মূলত চারটি অংশ রয়েছে। জৈনদের দশম তীর্থঙ্কর ভগবান শীতলনাথের শীতলনাথ মন্দির, অষ্টম তীর্থঙ্করের নামে চন্দ্রপ্রভুজি মন্দির, দাদাওয়াড়ি অর্থাৎ জৈন আচার্য শ্রী জিন দত্ত কুশল সুরি মহারাজের পদচিহ্ন এবং শেষ জৈন তীর্থঙ্করের নামে মহাবীর মন্দির।
ভগবান পরেশনাথের নামে এই মন্দির উৎসর্গ করা হয়েছে। এই মন্দিরটিতে জৈনরা তাদের ধর্মে ২৩তম তীর্থঙ্কর পরেশনাথের পুজো করেন। কলকাতা তথা গোটা বাংলার অন্যতম প্রধান জৈন তীর্থক্ষেত্র হিসেবে এই মন্দিরটি পরিচিত। সমগ্র মন্দিরটি ভিতরে বিভাজিত চারটি মূল ভাগে। মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে ভগবান শীতলনাথের হীরকখচিত কপালমূর্তি। দাদাওয়াদি মন্দিরটি শেষ জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীরের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। মন্দিরপ্রাঙ্গনের ভিতরের অসামান্য কারুকার্য এবং শতবর্ষ প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন আজও বিস্ময়। মন্দির জুড়ে রয়েছে অসংখ্য কারুকার্যের নিদর্শন। রয়েছে ফুলের বাগান এবং পুরনো ফোয়ারা। মন্দিরগুলির ভিতরের দেওয়ালে খুঁজে পাবেন চিত্রশিল্পী গণেশ মুসকারের আঁকা নানান পৌরাণিক চিত্রকলা।
পরেশনাথ মন্দিরের ভিতরের একটি পুকুরও রয়েছে, জলে রঙ বেরঙের নানান মাছ রয়েছে। ইচ্ছে হলে মাছেদের খাবার কিনে পুকুরে ছড়িয়ে দিতে পারেন। ভক্তদের বিশ্বাস, পরেশনাথ মন্দিরের মাছেদের খাবার খাওয়ালে পুণ্য সঞ্চয় হয়। প্রতি বছর ভাদ্র মাসে জৈনরা অহিংসা পালন করেন। এই সময়ে পরেশনাথ মন্দিরে বিশেষ পুজো হয়। জৈনদের নানান উৎসব, অনুষ্ঠান, পালা, পার্বণ এই পরেশনাথ মন্দিরে উদযাপিত হয়। প্রতিদিনই এই মন্দির খোলা থাকে। সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১টা অথবা বিকেল ৪টে থেকে রাত ৯.৩০টা অবধি ভক্তেরা মন্দির দর্শন করতে পারেন।
শোনা যায়, পরেশনাথ মন্দিরের গর্ভগৃহের ভিতরে একটি ঘিয়ের প্রদীপ রয়েছে, যা ১৮৬৭ সাল থেকে একটানা প্রজ্জ্বলিত হয়ে আসছে। আজ পর্যন্ত কখনও তা নিভে যায়নি। জৈনদের বিশ্বাস অহিংসা এবং শান্তির প্রতীক হিসেবে এই পুণ্যশিখা চিরদিনের জন্যে প্রজ্জ্বলিত থাকবে। অখণ্ডজ্যোতই এই মন্দিরের অন্যতম বিশেষত্ব।