নৃসিংহ চতুর্দশী ব্রতের গল্প

অবন্তিপুরে বসুশর্মা নামে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন। যজন-যাজন ঈশ্বরকথায় তিনি দিনরাত মগ্ন থাকতেন। তাই পাপচিন্তা তাঁকে স্পর্শও করতে পারেনি। সে-কারণেই রাজদ্বারে-গেরস্তের ঘরে ঘরে তাঁর সম্মানের অন্ত ছিল না।

বসুশর্মার পত্নীও খুব পুণ্যবতী নারী ছিলেন। তাঁদের পাঁচটি পুত্রসন্তান ছিল। পুত্রেরাও সকলেই বেশ বিদ্যা অর্জন করেছিল, বেদশাস্ত্রে পারদর্শী হয়েছিল। তবে পুত্রের মধ্যে চারজন পিতার চরিত্র পেলেও, ছোটটি কিন্তু পায়নি। সে বিদ্বান হলেও দুশ্চরিত্র। ব্রাহ্মণ হয়েও বারনারীতে আসক্ত। নাম তার, বাসুদেব।

বিদ্যালাভ ছাড়া সারা জীবনে বাসুদেব এমন কোন কাজ করল না, যে-জন্য পিতা বসুশর্মা গর্ব করতে পারেন; এমন কোন কাজ করল না, যে-জন্য সে আপন পরকালের পথ প্রশস্ত করতে পারে।

বারনারীতে আসক্ত হয়ে ক্রমে সে মদিরামত্ত হতে শিখল; মদিরা এবং বারনারীর অর্থ জোগাতে চৌর্যকর্মেও লিপ্ত হতে লাগল। গ্রামে-গঞ্জে এসব জানাজানি হতে সময় লাগে না। ফলে, তাই নিয়ে সমানে ছিঃছিঃক্কার চলতে লাগল। আর তার জন্য বসুশর্মার গৌরব প্রতিদিন ম্লান হতে লাগল, সকলের কাছে মাথা হেঁট হতে লাগল।

Nrisingha1

বসুশর্মা এতদিন ভালোভাবে তাকে কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত করার নানান চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু হতাশ হয়ে এবার আর পারলেন না, অবাধ্য ছেলেকে ত্যাগ করলেন।

বাপের প্রতি গালাগালির চূড়ান্ত করে বাসুদেব ঘর ছেড়ে তার বাঁধা বারাঙ্গনাটির ঘরে এসে উঠল। কিন্তু, ঘরখেদানো বাসুদেব যে গলগ্রহ হতে চলেছে, এটা বুঝেই বারাঙ্গনার মেজাজ দারুণ বিগড়ে গেল। অমনি রেগেমেগে বাসুদেবকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে তার মুখের ওপর দরজা দিয়ে দিল। 

বাসুদেব আর যাবে কোথায়, সেই দরজার বাইরেই সারাটি রাত পড়ে রইল। বাপের বাড়িতে খাবার জোটেনি, এখানেও জুটল না। সারা রাত উপোষে কাটতে লাগল। শুয়ে-বসে অস্থির হয়ে মনটায় যে তাই কত কথা আসতে লাগল : যারা তাকে আপন ভাবল না, তাদের ঘর তো ছেড়েই এল; যাকে সে আপন ভাবত, সেও তাকে জায়গা দিল না! তাহলে কোথাও কি তার কোন জায়গা নেই?

এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে তার বড্ড অনুশোচনা হল। বড্ড অভিমান হল, তেষ্টা পেল, তবু জল খেল না। সারারাত দু'চোখের পাতা এক হল না।

দূরে কোথাও হরিনামের জাগরণ চলছিল, ভেসে আসছিল নামগান। তাই শুনতে শুনতে আর অনুশোচনা করতে করতে ভোরবেলা সে মারা গেল।

বাসুদেব মরল বটে, তবে তাকে আবার জন্ম নিতে হল। সে জন্ম নিল ঘোর বিষ্ণু-বিদ্বেষী দৈত্য হিরণ্যকশিপুর পুত্র হয়ে। হরিনাম শ্রবণের পুণ্যে সে এবার পরম বিষ্ণুভক্ত হয়ে জন্মাল। নাম হল, প্রহ্লাদ।

হিরণ্যকশিপু শুধু বিষ্ণুভক্তই নয়, ব্রহ্মার বরে সকলের অবধ্য। দেব-মানব-দানব-পশু-পক্ষী কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে না। মাটিতে-আকাশে-পাতালে, দিনে-রাতে-অস্ত্রে-আগুনে-বাতাসে-জলে কোথাও কিছুতেই তাকে বধ করা যাবে না।

Nrisingha2

ব্রহ্মার কাছে এমন মারাত্মক বর পেয়ে সে দেবলোক থেকে দেবতাদের তাড়িয়ে সেখানকার রাজাই শুধু হল না, মর্ত-পাতাল অধিকার করে একেবারে ত্রিলোকপতি হয়ে বসল। অত্যাচারে-অনাচারে ভরিয়ে তুলল ত্রিলোক।

সেই অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা শরণ নিলেন ভগবান বিষ্ণুর। উদ্ধারের আকুতি নিয়ে হাজির হলেন তাঁর কাছে। তাঁদের আকুতিতে বিষ্ণু তুষ্ট হলেন, বরাভয় দিয়ে বিদায় দিলেন।

আসলে, বড় ভাই হিরণ্যাক্ষকে বিষ্ণু বধ করেছিলেন বলেই হিরণ্যকশিপু চরম বিষ্ণু-বিদ্বেষী। তাই তারই ঘরে পুত্র প্রহ্লাদ পরম ভক্তিভরে বিষ্ণুর পুজো করে চলেছে, এ-কথা যখন হিরণ্যকশিপুর কানে উঠল, তখন সে রাগে একেবারে কাঁপতে শুরু করল। প্রচণ্ড হুঙ্কারে ডেকে পাঠাল পুত্রকে।

রাগে কম্পিত পিতার সামনে এসেও প্রহ্লাদ অবিচল। বলল, তুমি ঠিকই শুনেছ পিতা, বিষ্ণুই আমার একমাত্র আরাধ্য। কোনকিছুর বিনিময়েই আমি তাঁর আরাধনা ভুলতে পারব না!

পুত্রের স্পর্ধা দেখে হিরণ্যকশিপু রাগে একেবারে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেল। কুলাঙ্গার পুত্রকে জলে ডুবিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে, হাতির পায়ের তলায় ফেলে, পাহাড় থেকে ফেলে নানাভাবে মারতে চাইল। কিন্তু, পারল না। প্রত্যেকবারই অদ্ভুত উপায়ে বেঁচে গেল প্রহ্লাদ!

তখন হিরণ্যকশিপু অবাক যেমন হল, তেমনি তার অধীনস্থ কোন অসুর নিশ্চয়ই প্রহ্লাদকে বাঁচাচ্ছে ভেবে রেগে একেবারে আগুন হয়ে গেল। সে বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলল, বল, কে তোকে বাঁচাল বল? 

প্রহ্লাদ তখনও শান্ত গলায় বলল, কেন, আমার প্রভু বিষ্ণু!

বিষ্ণুর নাম শুনে হিরণ্যকশিপু রাগে যেন অন্ধ হয়ে গেল। বলল, তোর এত সাহস, তুই আমার সামনে ফের ওই নাম উচ্চারণ করিস! বল সে কোথায়? তাকে এখনই বিনষ্ট করছি! বল কোথায় সে, বল!

বিষ্ণুকে হত্যার জন্য হিরণ্যকশিপু সরোষে গদা তুলে ধরল। তাই দেখে প্রহ্লাদ মুচকি হেসে বলল, তিনি সবখানেই আছেন। 

তারপর চোখ বন্ধ করে বিষ্ণুকে স্মরণ করে সামনের একটি থামের গায়ে হাত রেখে বলল, দেখার চোখ থাকলে এই থামের মধ্যেও তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়।

Nrisingha3

হিরণ্যকশিপু দাঁত চিবিয়ে বলল, বটে! তবে দেখি...

বলতে বলতে দুরন্ত গদার এক আঘাতেই সে থামটি ভেঙে ফেলল। অমনি সেই থামের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন বিষ্ণুর নব-অবতার। নিম্নাঙ্গ মানুষের, ঊর্ধাঙ্গ সিংহের। নর ও সিংহ মিলে নৃসিংহ বা নারসিংহ মূর্তি।

তাঁর এই অদ্ভুত মূর্তি দেখে হিরণ্যকশিপুও প্রথমটায় হতচকিত হয়ে গেল। তারপর শুরু করল যুদ্ধ। সে এক ভীষণ যুদ্ধ।

প্রবল ও দীর্ঘ অস্ত্রযুদ্ধ চলল শুধু সময়ক্ষয়ের জন্য। তারপর দিনাবসানে যখন সন্ধ্যা নেমে এল, সেই সন্ধিক্ষণে নৃসিংহ হিরণ্যকশিপুকে ধরে কোলের উপর রেখে তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে তার বুক চিরে তাকে মেরে ফেললেন। 

এভাবেই ব্রহ্মার বরের সমস্ত শর্ত মেনেই হিরণ্যকশিপুবধ সম্পন্ন হল। সম্পন্ন হতেই ত্রিলোকে মঙ্গলশঙ্খ বেজে উঠল। পুষ্পবৃষ্টি শুরু হল। শোনা গেল দেবতাদের নৃসিংহ-বন্দনা।

বন্দনা-গান শেষ হলে তৃপ্ত নৃসিংহদেব বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদকে নিজে সিংহাসনে বসিয়ে পাতাললোকের রাজা করে দিলেন। তারপর প্রভুত আশীর্বাদ করে অদৃশ্য হলেন। তাঁর আশীর্বাদে বিষ্ণুপদে মতি রেখে প্রহ্লাদ দীর্ঘকাল সুখে রাজত্ব করে একদিন স্বর্গে গেল।

ব্রতের কথা তো শেষ হল, এবার যেটা বলার সেটা হচ্ছে : নৃসিংহদেব যে-দিন আবির্ভুত হয়ে হিরণ্যকশিপুকে বধ করে ত্রিলোক রক্ষা করেছিলেন, প্রহ্লাদকে কৃপা করেছিলেন; সেই দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের চতুর্দশী তিথি। 

তাই, এ-দিনটি নৃসিংহদেবের আবির্ভাব তিথি হিসেবে পালন করা হয়। সমস্ত আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা পাবার আশা নিয়ে এবং প্রহ্লাদের মতো কৃপা পাবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এ-দিন 'নৃসিংহ চতুর্দশী ব্রত'ও পালন করেন অসংখ্য গেরস্ত।

পঞ্জিকার কল্যাণে এ-বছর বৈশাখে এ-তিথির মিল হয়নি, এসে পড়েছে জ্যৈষ্ঠে; সেই হিসেবেই 'নৃসিংহ চতুর্দশী ব্রত' পালিত হচ্ছে আজকের দিনটিতেই।


গল্পের উৎস: বেদব্যাস বিরচিত 'নৃসিংহ পুরাণ', বাংলার প্রচলিত গল্প এবং হিন্দুস্থানী ব্রতকথা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...