নীল পুজোর কাহিনী

বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্বন, ব্রতে ব্রতক্কার অবস্থা; তার মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি ব্রত হল নীল ষষ্ঠী! চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন সন্তানবতি জননী এই নির্জলা উপবাস ব্রত পালন করেন এবং সন্ধ্যা বেলায় শিবের মাথায় জল এবং নীলের ঘরে বাতি দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন। নীলকণ্ঠ হল নীল এবং নীলচন্ডিকা অর্থাৎ শিব- দুর্গার বিয়ের দিনকে মাথায় রেখেই এই ব্রত উদযাপন চলে।

“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে” সন্তানের মঙ্গলকামনা করার উৎসবই নীল ষষ্ঠী। অনেকে একে নীল পুজোও বলে থাকেন। গ্রাম বাংলায় এখনও শিব-দুর্গা সেজে নীলের গান গেয়ে যা অষ্টক গান নামে পরিচিত। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায় নীলসন্ন্যাসীদের। অনেকে আবার নিম বা বেল কাঠ দিয়ে তৈরি করেন নীলের মূর্তি। সেই মূর্তি সাজিয়ে শুরু হয় উৎসব। পরনে লাল কাপড়, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে ত্রিশূল নিয়ে নীলসন্ন্যাসীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। তাঁদের সঙ্গে দেন শিব-দুর্গা বেশের সঙেরা। গৃহস্থ মহিলারা বা গর্ভবতী মহিলারা এই নীলের মিছিল দেখলেই তাঁদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনেন। নীলের মাথায় তেল-সিঁদুর লেপে শুরু হয় পুজো। তারপরই নীলের গানে মেতে ওঠেন নীলসন্ন্যাসীরা।

“শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে

কৈলাসেতে হবে অধিবাস।

(ও) তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা

বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।

(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।

আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে, দেখে এসেছি মেয়ে

শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন,”

এই রকম নানান গান এখনও নীল ষষ্ঠীর দিন শোনা যায় গ্রাম বাংলায়।

নীল পুজো নিয়ে লোকের মধ্যে এক কিংবদন্তির প্রচলন আছে, যা বহু কাল আগের এক উপাখ্যান। কোন এক গ্রামে, বাস করত এক ব্রাহ্মণ আর এক ব্রাহ্মণী। তাঁদের সন্তান ভাগ্য ছিল খুব খারাপ। ছেলেমেয়ে জন্মালেই অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মারা যেত। অনেক বার ব্রত পালন করেও কোনও ফল না হওয়ায় তারা ঠিক করলো সব ছেড়ে কাশী চলে যাবে।

একদিন নানা তীর্থ ঘুরতে ঘুরতে কাশীর গঙ্গা ঘাটে বসে তাঁরা দু’জনে যখন দুঃখ করছে, তখন মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার বেশে এসে তাঁদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘হ্যাঁ গা, তোরা কাঁদছিস কেন?’ মনের দুঃখে ব্রাহ্মণী জানায়, “আমাদের সব সন্তান মারা গেছে। কেউ বেঁচে নেই। অনেক পুজো করেও ফল মেলেনি। তুমি বলো এখন কী করি?” সব শুনে বৃদ্ধা বলেন, “এ সব হয়েছে তোমাদের অহঙ্কারের জন্য। শুধু বার-ব্রত করলেই হয় না। ভগবানে বিশ্বাস থাকা চাই। মন দিয়ে তাঁকে ডাকতে হবে।’ব্রাহ্মণী তখন তাঁর পা ধরে বললেন, “কে তুমি, বল মা।” বৃদ্ধা বললেন, “আমিই মা ষষ্ঠী। শোন, এই চৈত্র মাসে সন্ন্যাস করবি এবং সেই সঙ্গে শিবপুজো করবি। সংক্রান্তির আগের দিন উপবাস করে নীলাবতীর পুজো করে নীলকন্ঠ শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে দিবি। আর তারপর আমাকে প্রণাম করে জল খাবি। একে বলে নীল ষষ্ঠী।” মা ষষ্ঠী এই কথা বলেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

Nil-Sasthi-buri

এরপর দেশে ফিরে ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী নীলের দিন খুব ভক্তি আর নিষ্ঠার সঙ্গে নীলষষ্ঠী ব্রত পালন করেন। তার কিছু দিন পরেই তাদের সুন্দর ছেলে জন্মায়। নীলষষ্ঠী ব্রতের এই মাহাত্ম্য দেখে দেশে দেশে সবাই তখন এই ব্রত পালন করতে আরম্ভ করে। অন্য একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, এক ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণীর পাঁচছেলে আর দুটি মেয়ে ছিল। তারা খুব ভক্তি সহকারে পুজো করত। কিন্তু এত পুজো, বারব্রত করেও তাদের সব ছেলেমেয়েগুলো একে একে মরে গেল। তখন ব্রাহ্মণীর ঠাকুরদেবতায় বিশ্বাস চলে গেল। তাদের আর সেই জায়গায় থাকতেও ভালো লাগল না। তারা ঠিক করল সব ছেড়ে, তারা মনের দুঃখে কাশীবাসী হবে। দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান করে অন্নপূর্ণার পুজো করে মণিকর্ণিকার ঘাটে বসে আছে, এমন সময় মা-ষষ্ঠী এক বুড়ি বামনীর বেশে এসে বললে "কি ভাবছ গো মা?" ব্রাহ্মণী বললে "আমার সব ছেলেমেয়েদের হারিয়েছি। এত পুজোআচ্চা সব বিফলে গেল আমাদের। সব অদৃষ্ট। ঠাকুর দেবতা বলে কিছ্ছু নেই।" ষষ্ঠীবুড়ি বললেন "বারব্রত নিষ্ফল হয়না মা, ধর্মকর্ম যাই কর ঈশ্বরে বিশ্বাস চাই। তুমি মা-ষষ্ঠীকে মানো? তাঁর পুজো করেছ কখনো? তিনি সন্তানদের পালন করেন। ব্রাহ্মণী বললে, 'আমি এযাবতকাল সব ষষ্ঠী করে আসছি কিন্তু তবুও আমার ছেলেরা র‌ইল না। 'ষষ্ঠীবুড়ি বললেন, "তুমি নীলষষ্ঠীর পুজো করেছ কখনো? চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন উপোস করে শিবের পুজো করবে। শিবের ঘরে বাতি জ্বেলে জল খাবে। সন্তানদের মঙ্গলকামনা করবে, বামনী সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে পুনরায় মাতৃত্ব লাভ করলে।এরপরেই ব্রতর প্রচলন হল, আজও তা চলে আসছে এবং এই ব্রত পালন করে মায়েরা মনে করেন যে তাদের সন্তান নীরোগ এবং দীর্ঘজীবী হবে।

চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন পালন করা হয় নীল ষষ্ঠী। এই সময় মাটি দিয়ে শোয়ানো অবস্থায় একটি দেব মূর্তি তৈরি করা হয়, যাকে শিবের মূর্তি বলা হয়। মূর্তিটি অমসৃণ, তাই ঠিক শিবের আদল বোঝা যায় না। নরম মাটি দিয়ে তৈরি এই মূর্তির গায়ে খেজুর দিয়ে আবরণ দেওয়া হয়। চারি পাশে খেজুর পাতা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়। কোথাও কোথাও মাটির মূর্তির বদলে একটি মাটির ঢিবি তৈরী করা হয়। এরপর ফুল, বেল পাতা দিয়ে শুরু হয় নীল পুজো। একই সঙ্গে চলে বালা গান। এই দিন বাড়ির মহিলারা সারাদিন ধরে উপোস করে থাকেন। বিকেলে পুজো দিয়ে তবেই কিছু মুখে দেন তাঁরা। সাধারণত পরিবারের সকলের স্বাস্থ্য ও মঙ্গল কামনার্থে নীলের উপবাস করে থাকেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...