১৬০৭ সন। বসন্ত বাতাস বইতে শুরু করেছে দিল্লি নগরীতে। সে হাওয়ার স্পর্শ নেশা জাগাচ্ছে মনে। হাওয়ার স্পর্শে রঙিন হচ্ছে গলি-মহল্লা-হাভেলির আনাচকানাচ। বসন্তের মেহেক রঙ ধরিয়েছে মোগল প্রাসাদেও। দরবার থেকে অন্দরে ছড়িয়েছে রঙ। মধু মাসের বাহারে সেদিন সেজে উঠেছিল রাজ আঙ্গিনার মীনাবাজারও।
মুঘল উদ্যান চারবাগে নকশাদার তাঁবু পড়েছে। এক এক তাঁবুতে এক এক পশরা। হাসির লহর উঠছে থেকে থেকে। লাস্যে-হাস্যে ভেসে যাচ্ছে মেহেফিল। বছরে একবার এ বাগিচায় তাঁবু পড়ে মীনাবাজারের। তার জন্য বছরভরের অপেক্ষা। মুঘল অন্তঃপুরের চান্দ-সিঁতারা নেমে আসে সেদিন মাটিতে। জেনানা মহলের আড়াল থেকে বেরিয়া শাহজাদীরা সখী সঙ্গিনী নিয়ে পা রাখেন মাটিতে। আসেন আমির-ওমরাহদের জেনানারাও। আয়নাচুড়ির চমক চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, হীরে, মানিক জহরত থেকে শুরু করে রেশম মুসলিন কী নেই সেখানে।
সেবারও ভর দুপুরের আলোয় জমে উঠেছিল মীনাবাজার, শুধু সে জশনের সব রঙ যেন শুষে নিচ্ছিল একটি তাঁবুও। সে তাঁবু থেকে চোখ সরছিল না কারও। মেয়ে পুরুষ সব্বার নজর সেই দিকে। মাঝে মাঝেই হাসুর হররা ছুটকে। সে তাঁবুর মেয়েরা হেসে গড়িয়ে পড়ছে একে ওপরের গায়ে। তবে সব তারা যেন একজনের গায়েই নেমেছে। আশ্চর্য তার রূপ। সে রূপের দিকে একবার তাকালে যেন চোখ অন্ধ হয়ে যায়। বছর ষোলোর এক সুন্দরী। শ্বেত স্ফটিকের মতো গা। দিনের আলোতেও ঝিকিয়ে উঠছে আলো। যেন জন্নতের হুরিপরী!
রাজপুরুষরা যে কোনও ছুঁতোয় একবার পা রাখতে চান সেখানে। দেখতে চান আসিখ খানের কন্যেকে। আরজুমন্দ বানু বেগম। বাবা আসিখ মুঘল দরবারের বড় উকিল।
হীরে জহরতের তাঁবু সেদিন টেনেছিল জাহাঙ্গীরপুত্র খুররমকেও। আর সেই মার্বেল সুন্দরী। বসন্তের দুপুরে সে মেয়ের কাছে একটিমাত্র হীরে চেয়েছিলেন তিনি। বদলে আরজুমন্দ দিয়েছিল স্ফটিক খন্ড। মূল্যবান হীরের দামেই কাচ কিনলেন যুবরাজ। আর সেই ষোড়শীকে আগাম নজরানা দিয়ে এসেছিলেন হৃদয়। সাক্ষী ছিল চারবাগের মাতাল হবসন্ত বাতাস।
দিনের সূর্য শামে ঢললে ভেঙেছিল দুপুরের জশন। কিন্তু খুরম হৃদয়ে তখন অন্য মেহফিলের সুবাস। দামাল যৌবনে পা রেখে এদিনে কম সুন্দরী দেখেননি। কিন্তু এই ঝড় তোলা মেয়ে তো জন্নতের আলো। বাদশার তৃতীয়পুত্র দেরী করতে চাননি। সেদিন বিকেলেই পৌঁছে গিয়েছিলেন আরজুমন্দের বাবার কাছে। আসিখ খানকে জানিয়ে দিলেন এই মেয়েকেই বেগম বানাতে চান তিনি।
আবুল হাসান খেতাব পেয়েছিলেন ‘আসিফ খান’। জাহাঙ্গীর স্বয়ং এই খেতাব দিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁর আরও একটি পরিচয় ছিল মুঘল দরবারে। তিনি ছিলেন বেগম নূর জাহানের ভাই। আবুল হাসান ওরফে আসিফ খানের বাবা মির্জা গিয়াস বেগ ছিলেন আকবর দরবারের প্রধান উজির। ‘ইতিমদ উল দুলাহ’ উপাধি পেয়েছিলেন। যার অর্থ সাম্রাজ্যের অন্যতম স্তম্ভ। মুঘল দরবারের এতটাই প্রভাব ছিল তাঁর। অর্থ এবং প্রতিপত্তিতে খানদানি পরিবার। পারসি সংস্কৃতির ধারায় প্রবাহিত।
বাগদানের পাঁচ বছর পর ১৬১২ এক্সালের ৩০ এপ্রিল নিকা হয়েছিল আঞ্জুমান আর খুররমের। পাঁচ বছর অপেক্ষার কারণও ছিল। রাজ জ্যোতিষীরা জানিয়েছিলেন পাঁচ বছরর পর যে যোগ তৈরী হবে তা বহু বছরের অপেক্ষায় আসে পৃথিবীতে। তাঁদের কথা মেনেই দীর্ঘ অপেক্ষায় সম্মত হয়েছিল দুই পরিবার। মুঘল যুবরাজের বিয়ের জশন চলেছিল এক বছর ধরে।
মুঘল রাজ পরিবারের বধূ হওয়ার পর বদলে গিয়েছিল আরজুমন্দের নাম। খুররম নন তাঁর নাম বদলে দিয়েছিলেন বাদশাহ জাহাঙ্গীর স্বয়ং। আরজুমন্দ বানু হয়েছিলেম মমতাজ-মহাল। যার অর্থ মহলের সবচেয়ে দামি রত্ন।
শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত অভিজাত ছিলেন তিনি। তিনি শের লিখতেন। যুবরাজ খুররম বাদশাহ হওয়ার পর আগ্রা ফোর্টে মমতাজের জন্য একটি মহল তৈরি করে দেন যার চার দেয়াল ছিল হিরে ও বহুমূল্য রত্ন দিয়ে তৈরি। মুঘল প্রশাসন ও শাসন নিয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। শাহজাহান তাকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে সম্রাট হওয়ার পর শাহী সিলমোহর মমতাজের কাছেই রাখতেন। যা রাজকীয় আদেশ জারী করার জন্য ব্যবহার করা হত। হাতির লড়াই দেখতে খুব ভালবাসতেন। ভ্রমণে খুব উৎসাহ ছিল। এক সময় যুদ্ধে যেতে চেয়েছিলেন।
দক্ষিণ ভারতে বুরহানপুরের মুঘল সেনাপতি খান জাহান মোহাম্মদ লোদি আহমদনগরের নিজাম শাহের সঙ্গে মিলিত হয়ে সম্রাট শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছিলেন। লোদীর বিদ্রোহকে দমনের জন্য শাহজাহানকে বোরহানপুর যেতে হয়েছিল। মমতাজ মহলও বাদশাহর সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন।
এডিকে মমতাজ মহল তখন পূর্ণ গর্ভবতী। তবুও শাহজাহান তাঁকে আগ্রা থেকে ৭৮৭ কিলোমিটারে দূরে বোরহানপুর নিয়ে যান। পথ ক্লান্তিতে মমতাজ অতিমাত্রায় দুর্বলও হয়ে পড়েন। হঠাৎ প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়। ১৬ জুন রাতের দিকে সেই যন্ত্রণা আরও অসহ্য হয়ে ওঠে। এডিকে সম্রাট শাজাহান বিদ্রোহ দমনের জন্য যুদ্ধের রণনীতি তৈরিতে ব্যস্ত।
মমতাজ বেগমের অবস্থার অবন্তির খবর তাঁর কাছে এলেও নিজে উপস্থিত হওয়ার ফুরসৎ নেই। তার বদলে সম্রাট শাহজাহান ধাত্রী পাঠানোর নির্দেশ দেন। অনেক লম্বা সময় ধরে কষ্ট সহ্য করে মমতাজ মহল গৌহর বেগম নামে একজন কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। প্রসবের সময় অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ ঘটে। ধাত্রী, হাকিম কেউই তা সামাল দিতে সক্ষম ছিল না।
শাহজাহান যখন নিজে মমতাজকে দেখতে যেতে চেয়েছিল, সে সময় তার কাছে খবর আসে যে মমতাজ তখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন। তাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে। এটা শুনে শাজাহান নিজে ঘুমাতে চলে যান।
সম্রাট শাহজাহানের যখন তখন সবে মাত্র দু ‘চোখের পাতা এক ক্রেছেন একটু। সেই সময় তার মেয়ে জাহানারা নিজে এসে তাঁকে মমতাজের কাছে যেতে বলেন। মমতাজ তখন মৃত্যুর যন্ত্রনায় ছটফট করছিল। দিনের আলো ফোটার আগেই মমতাজ মহল নিঃসাড় হয়ে যান। বয়স তখন ৩৭ বছর। তাপ্তি নদীর তীরে জোয়নাবাদ নামক বাগানে তাঁকে মাটি দেন বাদশাহ। তাঁদের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয় ১৯ বছর। শাহজাহানের ১৪ সন্তানের জননী তিনি।
মমতাজের মৃত্যুতে ছেঁড়াপাতার মতো অন্তঃপুরে হারিয়ে গিয়েছিলেন বাদশাহ। তখন কোথায় তাজ, কোথায় দ্রবার, প্রেমিকাহারা প্রেমিক আর ভারত সম্রাট তখন বিরহ দহনে এক। কীভাবে জুড়বে হৃদয়, কে দেবে সন্ধান! পথ খুঁজে খুঁজে তিনি ক্লান্ত। কিছুটা কি মলম দেয় যমুনার তীর? কেউ উত্তর জানে না।
কীভাবে বাঁচিয়ে রাখবেন প্রিয়তমাকে এই নশ্বর পৃথিবীর বুকে? সেই উত্তর যেন সত্যিই সত্যিই একদিন খুঁজে পান যমুনার তীরে। শ্বেত স্ফটিকেই ঢরে রাখবেন প্রিয়ার স্মৃতি। মমতাজের মৃতদেহ সোনায় মোড়া কফিনে করে বুরহানপুর থেকে নিয়ে আসা হল আগ্রায়। সাধারণ মানুষ ও প্রজারা তাদের সম্রাজ্ঞীকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য গ্রাম এবং শহর জুড়ে পথের দু’ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে চোখের জলে শেষ বিদায় জানিয়েছিল।
সেদিন পথের দুধারে দাঁড়ানো দরিদ্রদের মাঝে দু’হাতে সোনার মুদ্রা বিতরণ করা হয়েছিল।শাজাহান সৈন্যদের নিয়ে যমুনা নদীর তীরে মমতাজের কবরের পাশেই দিন কাটাতেন।
মমতাজের স্মৃতিতে গড়া মহল গড়তে খরচ হয় চার কোটি টাকা। ২০ হাজার সুদক্ষ কর্মী লাগাতার শ্রম দিয়েছিল নির্মাণ কাজে। মহলের নাম রাখা হয় তাজমহল। দিনে তার এক রূপ, রাতে আর এক। এই জাত-ঢর্ম-ভাষা-জাতি নির্বিশেষে তাজ এই পৃথিবীর মানবমানবীর কাছে প্রেমের রূপকথা। জীবনে একবার হলেও তার কাছে আসতে চায় তারা। ছুঁয়ে দেখতে চায় তার স্ফটিকগাত্রকে।
তাজমহলের নির্মাণ নিয়ে বিতর্ক কম নেই। তবু মহান হয়ে থাকে প্রেমের গাথাটুকুই আর অকালপ্রয়াতা এক নারী। বেদনায় জেগে ওঠে তার মুখ। এমনই এক প্রখর বৈশাখে আগ্রা নগরীতে জন্ম নিয়েছিলেন ইতিহাস মানবী আরজুমন্দ। তার জন্যই মহাকবি লেখেন কাব্যগাথা-
হীরামুক্তামাণিক্যের ঘটা
যেন শূন্যদিগন্তের ইন্দ্রজাল ধনুচ্ছটা,
যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক,
শুধু থাক একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল।
তথ্যসূত্রঃ The Cause of The Taj:: Mumtaz Mahal
The Heritage Lab