বাংলায় শক্তি পুজোর ইতিহাস বেশ পুরনো। একদা বাংলার বাঙালিরা শক্ত ও শৈবতেই কেবল বিভক্ত ছিল। বাংলা প্রসিদ্ধ কালীক্ষেত্রও বটে। বঙ্গদেশে কালীপুজো কবে শুরু হয়েছে, কে শুরু করেছিলেন, সেই নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে বিস্তর। বঙ্গদেশে নানা ধরনের কালীমূর্তির প্রচলন রয়েছে। দক্ষিনা কালী, বামা কালি, চিৎ কালী, শীর কালী, রক্ষা কালী, শ্মশান কালী, রণ কালী, ভদ্র কালী, গুহ্যকালী, শ্যামা কালী ইত্যাদি অগুনিত বলে শেষ করা কার্যত অসম্ভব। প্রত্যেক রূপের পুজো পদ্ধতি আলাদা। তবে বঙ্গ কালী পুজোর প্রচলন ও বিস্তারের জন্যে বঙ্গবাসীর নদীয়ার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত। বৈষ্ণব ধর্মের পীঠস্থান, নিমাইয়ের জেলা কী করে কালী পুজোর প্রচলনে অগ্রণী ভূমিকা নিল? সত্যিই তা ভাবতে গেলে অবাক হতেই হয়।
ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ, বাংলায় তখন শাক্ত-বৈষ্ণবদের মধ্যে তীব্র বিরোধ চলছে। আরেক দিকে শ্রীচৈতন্য দেব উঠে আসছেন, মহাপ্রভুর ভক্তিরসে ডুব দিয়েছে বাংলা। বীরাচারী তান্ত্রিকেরা মেতেছেন তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে; শবসাধনা, নরবলি নানা ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে শক্তি পেতে তারা মত্ত। তদানিন্তন সময়ে মূর্তিতে নয়, শিলাখণ্ড, যন্ত্র এবং ঘটে কালী আরাধনা হত। তাও আবার গৃহস্থ বাড়িতে বা বারোয়ারি ভাবে নয়, এমনকি মন্দিরেও নয়। লোকচক্ষুর আড়ালে শ্মশানে, নদীতীরে বা জঙ্গলে পূজিত হতেন কালী মা। এমনই এক সময় দ্বৈববাণীতে কালীর রূপ খুঁজে পেলেন নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তিনি ছিলেন চৈতন্য সমসাময়িক।
অনেকের মতে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগিশই বঙ্গদেশের বহুল পরিচিত কালীমূর্তির প্রচলন ঘটান। আগমবাগিশের সাধনা ক্ষেত্র হল নবদ্বীপ। মতান্তরে শান্তিপুর। বর্তমানে নবদ্বীপ ও শান্তিপুর উভয় শহরেই আগমবাগেশ্বরী মায়ের পুজো হয়। নদীয়াই ছিল বাংলার শক্তি উপাসনার পীঠস্থান। এই শান্তিপুরের নিত্য কালী, বামা কালী, সিদ্ধেশ্বরী চাঁদুনি মা খুবই বিখ্যাত। সাধনাকালী, বোম্বেটেকালীর পুজো বেশ জনপ্রিয়।
তবে আরও দুই কালীর কথা আজ বলব। মহিশখাগী কালীমা বা মহিষাখাগী কালী মা। নদীয়া জেলার শান্তিপুর শহরের অন্যতম প্রাচীন পুজো এটি। প্রায় ৫০০ বছরে আগে মহিশখাগী কালীমাতার পুজো আরম্ভ হয়েছিল। সে হিসেবে এই পুজোর বয়স পাঁচ শতাব্দীরও বেশি। শোনা যায় চ্যাটার্জী বংশের এই বিখ্যাত পুজো শুরু হয়েছিল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে ধরে। মহিশখাগী কালীমার মন্দিরটিও নির্মাণ করে দিয়েছিলেন স্বয়ং মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। তবে বর্তমানে বারোয়ারি পুজো হিসেবেই মহিশখাগী কালীমাতা পূজিত হয়ে আসছেন। কথিত রয়েছে, মা কালী খুবই জাগ্রত। প্রথমদিকে মন্দিরটি একটি কুঁড়েঘরের আদলের ছিল। চ্যাটার্জি বংশের পারিবারিক দেবী মহিশখাগী কালীমা, পরে তারাই জনসাধারণে হাতে পুজোর দায়ভার দিয়ে যান। পুজো বারোয়ারি রূপ নেয়। নতুন করে মন্দিরটিও গড়ে তোলা হয়েছে।
শোনা যায় বিবাহ রীতি অনুযায়ী মহিশখাগী কালী মায়ের পুজো করা হয়। মাকে প্রথম পাটে ওঠানোর দিনে বিভিন্ন নিয়মরীতি পালন করা হয়। পাটে ওঠানোর পরে মন্দির প্রাঙ্গণ পরিষ্কার করে সেদিন ভোররাতে দধিমঙ্গল হয়। তারপর অমাবস্যা শুরু হলে বিবাহ রীতি মেনেই পুজো করা হয়। পর দিন প্রতিপদে পালন করা হয় বাসী বিয়ের রীতি। বাসী বিয়ের রীতি অনুযায়ী পূজিত হন মা। পুজো সম্পন্ন হওয়ার পর মাকে বিসর্জন এর জন্যে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে শোনা যায়, বহু বছর আগে এই পুজোয় মহিষ, পাঠা বলি দেওয়া হত। মহিষ বলি থেকেই হয়ত মহিষাখাগী নামটি এসেছে। তবে অনেক বছর আগে একবার পুজো শুরু করতে দেরি হয়ে যাওয়ায় বলি দানের সময় পেরিয়ে যায়। সেই দিন থেকেই মহিশখাগী কালী মায়ের পুজোতে যেকোন রকম বলি নিষিদ্ধ করা হয়। সেই থেকেই মহিশখাগী মাতার পুজোতে বলি প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
চিরাচরিত নিয়ম মেনেই মা মহিশখাগীর বিসর্জন হয় ভক্তদের কাঁধে চেপে। জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকী অন্যান্য জেলার থেকেও হাজার হাজার মানুষ আসেন এই মহিশখাগী মায়ের বিসর্জন দেখতে। মাকে একটা বারের জন্য দেখতে ভিড় জমে রাস্তার দুপাশে।
অন্যদিকে মা আগমেশ্বরীকে শান্তিপুর শহরের প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন ঘাটে মায়ের বিসর্জন দেওয়া হয়। কাতারে কাতারে লোক আসে মা আগমেশ্বরীর বিসর্জন দেখার জন্য। প্রাচীনকাল থেকে এভাবেই শান্তিপুরের দুই প্রতিমার বিসর্জন হয়ে আসছে। প্রায় সাড়ে চারশো বছরেরও বেশি প্রাচীন, শান্তিপুরের দুই বড় এবং ঐতিহ্যবাহী কালী ঠাকুরের নিরঞ্জন দেখার জন্যে মুখিয়ে থাকেন মানুষজন। প্রত্যেকবছর দুই কালী মা মহিশখাগী এবং মা আগমেশ্বরী নিরঞ্জন হয় কিছু সময়ের ব্যবধানে। এই বিসর্জনকে ঘিরে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়।
শান্তিপুরের আরেকটি প্রাচীন পুজো ঠাকুরপাড়ার জজ-পণ্ডিত বাড়ির পুজো। জজ-পণ্ডিত বাড়ির দেবীর নাম হল মা পক্কানেশ্বরী কালী। পরিবারের অন্যতম বিখ্যাত পূর্বপুরুষ পীতাম্বর চট্টোপাধ্যায় এই পুজো শুরু করেন। শোনা যায়, তিনিই ইংরেজ সরকারের কাছে জজ-পণ্ডিত উপাধি পেয়েছিলেন। এই পুজো অন্যতম বৈশিষ্ট হল, দেবীর পাটে ওঠার সময় একটি পাঁঠাবলি হয়। সম্পূর্ণ তান্ত্রিক মতে এই পরিবারে মা কালীর আরাধনা হয় পুজো চলে। আগে জজ-পণ্ডিত বাড়িতে প্রতি অমাবস্যায় কালীপুজো হত। এখনও মধ্যে রাতে রাত ১২টায় এদের পুজো শুরু হয়। ভোগে অন্ন, শুক্তো, পাঁচ ভাজা, বিভিন্ন রকম ডালনা, তরকারি, মাছ, মাংস, মিষ্টি, পায়েস দেওয়া হয়। এক আসনে পুজো হয়, পরের দিন সকালে বিসর্জনের আগে পুজো হয়। দুপুরে দেবীকে বেদী থেকে নামানো হয়। তারপরে বরণ ও সিন্দুর খেলা চলে। এরপর দেবীর নিরঞ্জন হয়। এই পুজোয় প্রসাদ হিসেবে পক্কান্ন দেওয়া হয়। মনে করা হয় সেই জন্যেই দেবীর নাম মা পক্কানেশ্বরী কালী।