জগন্নাথের শ্রীমন্দিরে কীভাবে ‘প্রসাদ’ হয়ে ওঠে ‘মহাপ্রসাদ’, জানেন?

কলিকালের দেবতা দারুদেব। তিনি ভক্তদের কাছে পূজিত হন পতিপাবনরূপে। তাঁর কাছে উচ্চ-নীচ, জাতপাতের ভেদ নেই। জঙ্গলের গভীরে শবরারাজ বিশ্বাবসু দ্বারা  পূজিত হতেন ভগবান নীলমাধব। তাঁর শ্রীক্ষেত্র আগমন বিশ্ববসুর জামাতা বিদ্যাপতির সূত্রে। কথিত আছে তিনি উড়িষ্যারাজকে স্বপ্ন দিয়ে বলেন, তাঁর পূর্বসেবকের থেকেই সেবা পেতে চান তিনি। তাই বিদ্যাপতিও ললিতার বংশধররাই বংশপরম্পরায় তাঁর সেবা করবে। তাঁরাই রাঁধবেন জগন্নাথের ভোগ।

জগন্নাথের মন্দিরে ভক্তরা আকুল হয় তাঁর ‘প্রসাদ’ পেতে। এ শুধু প্রসাদ নয়,  যে মহাপ্রসাদ। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব প্রথম ‘মহাপ্রসাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। শ্রীকৃষ্ণের অধর স্পর্শ করেছে যে প্রসাদ তাই মহাপ্রসাদ। মহাপ্রসাদ সকলের। ভেদাভেদ নির্বিশেষে।

জগন্নাথের ভোগপ্রসাদ ‘মহাপ্রসাদ’ হয়ে ওঠে না বিমলামায়ের যোগ ছাড়া। প্রসাদের মহাপ্রসাদ হয়ে ওঠা নিয়ে প্রচলিত আছে একাধিক কাহিনি। সেরকমই এক লোককাহিনির আখ্যান অনুযায়ী বিষ্ণুর ভক্ত ছিলেন শিবশম্ভু। একাবার তাঁর ইচ্ছে হল গোলকধামে গিয়ে বিষ্ণুর দর্শন করবেন। সেইমতো কৈলাশ থেকে রওনা হলেন গোলকের উদ্দেশ্যে। যখন বিষ্ণুধামে এলেন তখন নারায়ণ আহারে বসেছেন। শিব অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁর আহার সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য।

আহার সমাপন হলে শিব বিষ্ণুর সাক্ষাৎ হল। চরণবন্দনা, সৃষ্টি-স্থিতি নিয়ে ভাব আলোচনা সব বিনিময় হওয়ার পর বিদায়ক্ষণ এসে উপস্থিত। তখন মহাদেব বিষ্ণুর কাছে প্রসাদ প্রার্থনা করলেন। এদিকে নারায়ণের ভোগ্য আহারের কিছুমাত্র অবশিষ্ট ছিল না। এই যখন অবস্থা তখন শিব দেখতে পেলেন নারায়ণের থালার পাশে কিছু অন্ন লেগে আছে। ত্নি সেই অন্নই নারায়ণের প্রসাদ জ্ঞানে নিয়ে মুখে দিলেন। সে প্রসাদের এমনই গুণ যে ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন মহাদেব। তাঁর মুখে লেগে রইল অন্নের অংশ। সেই অবস্থাতেই কৈলাসে ফিরলেন তিনি।

কৈলাসে যখন তিনি এলেন তখন দেবর্ষি নারদ উপস্থিত সেখানে। তিনি মহাদেবকে দেখেই বুঝতে পারলেন অন্নের রহস্য। তিনিও মহাদেবের থেকে গ্রহণ করলেন নারায়ণের প্রসাদ।

এই লীলা যখন চলছিল তখন দূর থেকে তা অবলোকন করছিলেন দেবী পার্বতী। তিনিও শিবের কাছে এসে প্রসাদ দাবী করলেন। কিন্তু শিবের কাছে আর কিছুই নেই। শুনে দেবীর খুব অভিমান হলে। তিনি চললেন নারায়ণের কাছে ।

গোলকধামে এসে নারায়ণকে বললেন, “আমার কী এমন অপরাধ যার, জন্য আমি প্রসাদ পাব না?”

তখন নারায়ণ তাঁকে প্রবোধ দিলেন, কলিকালে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে দেবী পার্বতী তাঁর মন্দিরে তাঁর শক্তি রূপে অবস্থান করবেন। তখন তাঁর প্রসাদই দেবী প্রসাদ রূপে গ্রহণ করবেন। সেই প্রসাদ হবে মহাপ্রসাদ।

শ্রীক্ষেত্রে সারাদিনে ছ’বার ভোগ নিবেদন করাহয় জগন্নাথকে। বাল্যভোগ, সকাল বা ধূপ বা রাজভোগ, ছত্রভোগ, দ্বিপ্রহরধূপ বা মধ্যাহ্নভোগ, সন্ধ্যাধূপ, বড়শৃঙ্গার ধূপ।

     প্রতিদিন জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরামকে ভোগ নিবেদনের পর ভোগের প্রধান পাত্র প্রতিদিন দেবী বিমলার মন্দিরে আনা হয়। তাঁকে নিবেদন করার পর সেই পাত্র শ্রী মন্দিরের গর্ভগৃহে ফিরিয়ে আনা হয়। সেই ভোগ অন্যান্য পাত্রে মিশিয়ে দিলে তবেই হয় তা মহাপ্রসাদ।

শনা যায় ভোগ যখন জগন্নাথের উদ্দ্যেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাতে বিখ্যাত সুগন্ধের লেশ কিছুমাত্র থাকে না, কিন্তু বিমলা মাকে উৎসর্গের পর সুগন্ধ মিগে যায় অন্নের প্রতিটি কনায়। এই মহাপ্রসাদের কাছে কেবল ভক্তিই সত্য। সব ভেদাভেদ মিথ্যা।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...