পুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে। ঠাকুর দেখা, ঢাকের আওয়াজ ইত্যাদি শোনার জন্যে মন একেবারে উদগ্রীব। হাতে কয়েকটি আঙুলে গোনা দিনের অপেক্ষা। আজকের দুগ্গা কথায় উত্তরের এক পুজোর কথা। শ্যামবাজারের ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি, ঠিক উল্টোদিকের লাল পাথরের বাড়িটার নেমপ্লেট দেখবেন। এই সেই সুপ্রাচীন লাহাবাড়ি। কলকাতার বনেদি পুজোর ইতিহাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে এই বাড়ির ঐতিহ্য। শিবের কোলে দুর্গার এমন মোহনীয় রূপ কলকাতার আর কোথাও দেখা যায় না। লাহাবাড়ির পুজো নিয়ে কিংবদন্তির ইয়ত্তা নেই। মনে করা হয় লাহা বংশে প্রথম পুজো শুরু করেন বনমালী লাহা তাও আবার বর্ধমানের বড়শূল গ্রামে। তারপরে লাহা বংশের মধুমঙ্গল লাহা পুজো করেন চূঁচুড়ায়। সবশেষে দূর্গাচরণ লাহা প্রথম কলকাতায় দুর্গাপুজো শুরু করেন।
লাহা বাড়ির পুজো ধারেভারে বাড়ে শিবচরণ লাহার আমলে। প্রাচীন কলকাতার বিখ্যাত ল বাড়ির পুজো হত বৈভব ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে। বৈষ্ণব রীতিতে পুজো চলত। বাবুয়ানির দেখনদারি নয়, ভক্তিই লাহাবাড়ির পুজো মূল। আজও প্রতি বছর পূজিত হন দেবী দুর্গা। এবাড়ির প্রতিমা শিবের কোলে অস্ত্রবিহীন দুর্গা। দেবী এখানে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিত হন না, দেবী এখানে বরাভয় মূর্তিতে বিরাজ করেন। দুই হাত বিশিষ্ট দেবীর দুই পাশে গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী থাকেন। শিবের বাহন ষাঁড়ের উপস্থিতিও এখানে যায় না। দেবীমূর্তিতে মহিষাসুর থাকেন না। অভয়া মূর্তি, হরগৌরী মূর্তি ইত্যাদি রূপে এখানে দেবী দুর্গা পূজিতা।
জন্মাষ্টমীর দু-তিনদিন পরই লাহাবাড়ির কাঠামো পুজো হয়। দেবীর মূল পুজো শুরুর আগে পর্যন্ত একটি ছোট্ট মাটির গণেশকে লাহা বাড়িতে দেবীরূপে পুজো করা হয়। পুজোর সময় পঞ্চমী আর ষষ্ঠীতে পরপর রচনা, কল্পনা আর অধিবাস অনুষ্ঠিত হয়। ষষ্ঠীর দিন সমস্ত রূপার অলঙ্কারে সাজানো হয় দেবীকে। লাহাবাড়িতে দেবীর ভোগে তিল, নারকেল, সুজি, বেসন ইত্যাদি নানা স্বাদের নাড়ু তৈরি হয়। ভোগে একুশ প্রকারের মিষ্টি দেওয়া হয়। লাহাবাড়িতে অন্নভোগ বাপশুবলি হয় না।
এ বাড়ি এখন একাধিক শরিকে বিভক্ত৷ প্রতি বছরই পালা বদল করে পুজোর দায়িত্ব ভাগ হয়৷ আজও মহিষাসুরমর্দিনী নন, লাহা পরিবারে দেবী দুর্গা পূজিত হন জগজ্জননী হিসেবে। কাঠামোর মধ্যে একটি ছোট্ট মাটির গণেশকে পুজো করা হয়। পরে যখন বড় গণেশ তৈরি হয়, তখন সেই ছোট্ট গণেশটা বড় গণেশের পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম থেকে একচালার প্রতিমাই পুজো হয় এই পরিবারে। এই বাড়িতে দুর্গাপ্রতিমাকে প্রতীকী হিসেবে পুজো করা হয়। যেহেতু এই পরিবারে দুর্গাপুজো হয় তাই এই বাড়িতে আর কোনও মূর্তি পুজো হয় না। বাড়ির কুলদেবী অষ্টধাতুর সিংহবাহিনীর পুজো হয় পুজোর চারদিন। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী লাহা পরিবার মহিষাসুর বধকে হিংস্র মনে করে। তাই এ বাড়িতে মা দুর্গা দশভুজা হয়ে আসেন না। তিনি আসেন হরগৌরী রূপে। দুর্গা বসেন স্বামী শিবের কোলে। শিবের বাহু ডোর তাঁকে বেষ্টন করে থাকে। দুর্গার দুচোখ বন্ধ থাকে। পরিবারের গৃহদেবীও তিনি। অষ্টধাতুর সেই মূর্তির নাম জয় জয় মা। পুজোর কয়েকদিন ঠাকুর দালানে তিনিও পূজিত হন। পুজোর পরে তাঁকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ঠাকুরঘরে। কথিত আছে, অষ্টধাতুর সেই মূর্তিকে জঙ্গলে ফেলে রেখে গিয়েছিল ডাকাতদল। লাহা পরিবারের কর্ত্রী নবকৃষ্ণ লাহার স্ত্রী দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। দেবীর নির্দেশমতো তাঁকে জঙ্গল থেকে এনে লাহা বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর থেকে লাহা পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি হতে শুরু হয়। পরিবারের ইতিহাস বলছে, এই পুজো প্রায় আড়াই শতকের বেশি পুরন। তবে নবকৃষ্ণ লাহা নাকি দুর্গাচরণ লাহা, কে এই পুজোর প্রবর্তন করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকেই বলেন, দুর্গাচরণের অন্তত তিন পুরুষ আগে লাহাবাড়িতে দুর্গোৎসবের সূচনা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন রাজীবলোচন লাহা‚ আবার কারও মতে তস্য পুত্র প্রাণকৃষ্ণ লাহা দুর্গাপুজো আরম্ভ করেছিলেন।
পুজোর সময় ষষ্ঠীতে বোধনের সময় পরিবারের কুলদেবী সিংহবাহিনীকে রুপোর সিংহাসনে বসিয়ে পুজো করা হয়। এদের পুজোতে পশুবলি হয় না। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এরা ছাঁচিকুমড়ো ও শশা বলি দেন। এই পরিবারে দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ হল অষ্টমীর সন্ধিপুজো। সন্ধিপুজো যতক্ষণ চলে ততক্ষণ বাড়ির মহিলারা দু-হাতে ও মাথায় মাটির সরার মধ্যে ধুনো জ্বালিয়ে ঠাকুর দালানে বসে থাকেন।
নবমীর দিন দেবীর জন্যে খই, মুড়কি, মিষ্টি ইত্যাদি একটা হাঁড়িতে ভরে নিবেদন করা হয়, একে বলা হয় কোলহাড়ি দেওয়া। দশমীতে বেলপাতায় দেবীর নাম লিখে বাড়ির পুরুষেরা দেবীকে অর্পণ করেন। দশমীর অঞ্জলি সারেন পুরুষরাই। কুলিদের কাঁধে চড়ে দেবী দুর্গা যান বিসর্জনে। এরপরের বিসর্জন সেরে বাড়ি ফিরে আসেন পুরুষরা, বন্ধ দরজার বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করেন মা আছেন কিনা আর ভিতর থেকে মহিলারা জানান মায়ের অবস্থানের কথা। এভাবে তিনবার পরপর জিজ্ঞাসা করার পরে পুরুষরা দরজা খুলে ভিতরে ঢোকেন। এমন রীতি লাহাবাড়ির দুর্গাপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট। প্রতিমা বিসর্জনের রীতিটি সত্যিই অভিনব। প্রথমে মাটির দুর্গাপ্রতিমা এবং তাঁর সামনে বিরাজমান জয় জয় মাকে বরণ করেন বাড়ির মহিলারা৷ তারপর জয় জয় মা অর্থাৎ সিংবাহিনীর মূর্তিকে বাড়ির ঠাকুর ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ এরপর দড়ি দিয়ে মাটির প্রতিমা বেঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়৷ যেহেতু কাঁধে করে শব নিয়ে যাওয়া হয়, সেই কারণে দেবী প্রতিমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হয় না এই বাড়িতে৷ বাড়ি থেকে দুর্গা প্রতিমা বেরিয়ে যাওয়ার পর বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিসর্জন দিয়ে কাঠামো না ফেরা পর্যন্ত বাড়ির দরজা বন্ধ থাকে৷ কথিত আছে, বিসর্জন শেষে বাড়ি ফিরে স্নান করছিলেন বাড়ির কর্তা দুর্গাচরণ লাহা। সেই সময় দেখেন, এক বালিকা এসে ভিক্ষা চাইছে। বিরক্ত হয়ে তিনি তাকে তাড়িয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর দুর্গাচরণ উপলব্ধি করলেন‚ ওই বালিকা আর কেউ নয়‚ স্বয়ং মা দুর্গা। এরপর তাঁর সময় থেকে শুরু হয় এই পরিবারের দুর্গাপুজোর এক নতুন নিয়ম। বিসর্জনের সময় বন্ধ থাকে বাড়ির সব দরজা এবং জানালা। প্রধান দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় দুর্গা প্রতিমা। তারপর বন্ধ হয়ে যায় সেই দরজা। বাড়ি ফিরে কর্তা সদর দরজার বাইরে থেকে তিনবার চেঁচিয়ে প্রশ্ন করেন, "মা কি আছেন বাড়ির ভিতরে?" গৃহকর্ত্রী আড়াল থেকে উত্তর দেন‚ পারিবারিক দেবী জয় জয় মা ফিরে গিয়েছেন ঠাকুরঘরে। আর মা দুর্গা রওনা হয়েছেন কৈলাসের পথে। এই উত্তর পেয়ে গৃহকর্তা প্রবেশ করেন বাড়িতে।
আবার হুগলির কামারপুকুরেও রয়েছে আরেক লাহা বাড়ি, কামারপুকুরের লাহাবাড়ির শতাব্দী প্রাচীন পুজো নিয়ে রয়েছে ইতিহাস। জমিজমা সংক্রান্ত আইনি বিবাদে জড়িয়ে পড়ে মামলায় হাজিরা দিতে যাচ্ছিলএন ধর্মদাস লাহা। গ্রামের মেঠোপথ ধরে সেই মামলার শুনানিতে হাজিরা দিতে তিনি চুঁচুড়া আদালতে যাচ্ছিলেন। পথে ক্লান্ত হয়ে এক গাছের নীচে বিশ্রাম নিতে শুরু করেন। সেই সময়ে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে মা তাঁকে বলেন, মামলায় জয়ী হবি তুই, বাড়ি গিয়ে আমার পুজো শুরু করিস। খানাকুল থেকে দুইজন পটুয়া যাচ্ছে।
মায়ের কথা সত্যি হয়। মামলায় জিতে মায়ের স্বপ্নাদেশের কথা ভুলে যান ধর্মদাস। কিন্তু বাড়ি ফিরে চমকে যান তিনি। দেখেন খানাকুল থেকে দুই প্রতিমাশিল্পী হাজির। পটুয়ারা ধর্মদাসবাবুকে জানাল, একটি মেয়ে এসে তাদের দুর্গা প্রতিমা গড়ার কথা বলে। তাই তারা এসেছেন বলে জানান। সেই থেকেই লাহাবাড়ির দুর্গাপুজো শুরু। তারপর পুজো চলে ১১২৭ থেকে ১১৮২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত। বর্তমানে সেখানে মায়ের মন্দির অবস্থিত। যা ১২০২ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মহালয়ার পরের দিন থেকে এখানে একটা যাত্রা পালা শুরু হয়। সেই মঞ্চ আজও রয়েছে। মা দুর্গা নাকি যাত্রা শুনতে ভালোবাসতেন। সেই রীতি মেনে এখনও বংশ পরম্পরায় যাত্রাপালা হয়ে আসছে। মহালয়ার দিন থেকে আট দিনব্যাপী যাত্রাপালা হয়। যাত্রাশিল্পীরা বলেন, মা দুর্গার কাছে প্রথম যাত্রাপালার অনুষ্ঠান করেন। তা হলে সারা বছর তাঁদের খুব ভালো ভাবে কাটে। নবমীর দিন এখানে কুমারীপুজো হয়। লাহা পরিবারের পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রামকৃষ্ণের ছোটবেলা। একদা কোন কারণে ঠাকুর রঙ করার কারিগর না আসায় ছোট্ট রামকৃষ্ণ লাহা বাড়ির মা দুর্গার চোখ এঁকে দিয়েছিলেন।