ঘোড়ার খুরের পদধ্বনি সভ্যতার চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। এক দেশ থেকে আরেক দেশ দখলের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ঘোড়া। যে রাজার আস্তাবলে যত বেশি ঘোড়া সে তত বলশালী। অশ্বমেধের যজ্ঞ ছিল ঘোড়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শক্তি প্রদর্শনের এক অন্যতম মাধ্যম।
প্রাচীন ভারতবর্ষে ঘোড়ার আমদানি করা হত সাধারণত পারস্য থেকে। বিজয়নগর সাম্রাজ্যে ঘোড়া আসত পর্তুগাল থেকে। সুলতানি আমলে সাম্রাজ্যের নীতি নির্ধারণের মূল হাতিয়ার ছিল ঘোড়া। যুদ্ধের পাশাপাশি বিনোদনের মাধ্যম ধীরে ধীরে হয়ে উঠল ঘোড়া। ঘোড়াকে নামালো হল রেস ট্র্যাকে। শুরু হল হর্স রেস। ভারতে প্রথম রেসকোর্স গড়ে ওঠে ১৭১৭ সালে মাদ্রাজে।
ব্রিটিশরা হর্স রেসকে একটি সুসঙ্গবদ্ধ রূপ দেয়। ইংরেজদের আধিপত্য বৃদ্ধির পর সেনাবাহিনীর জন্য একাধিক বেস ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়েছিল। সেনার বেস ক্যাম্পগুলোতে অবসর সময়ের বিনোদনের জন্য আয়োজিত হতে শুরু করল হর্স রেস।
১৬ জানুয়ারি ১৭৬৯ সালে ব্রিটিশ ক্যাভারলি কলকাতার কাছে "আকড়া" নামক জায়গায় প্রথম ঘোড় দৌড়ের ব্যবস্থা করে। এরপর থেকে কলকাতায় ঘোড় দৌড় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। প্রথমদিকে মূলত চারটি ঘোড়া নিয়ে রেস চালু হয়। ১৭৯৮ খ্রীষ্টাব্দে গভর্নর লর্ড ওয়েলেসলি হর্স রেস বন্ধ করে দেন। ঠিক তার পাঁচ বছর পর ১৮০৩ খ্রীষ্টাব্দে আকড়ায় "বেঙ্গল জকি ক্লাব" গড়ে ওঠে। ১৮০৯ সালে কলকাতা ময়দানে এই ক্লাব স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৮২০ সালে "কলকাতা রেসকোর্স" প্রতিষ্ঠিত হয়।
"বেঙ্গল জকি ক্লাবের" সঙ্গে "ইংল্যান্ডের জকি ক্লাবের" এই সময় একটা যোগাযোগ তৈরি হয়। উভয়ের উদ্যোগে ১৮৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি স্থাপিত হয় "ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব"। ১৯১২ সালের ৪ জানুয়ারি রাজা পঞ্চম জর্জ এলেন কোলকাতার রেসকোর্সে। সঙ্গে রানি মেরি। সেই বছর থেকে "ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের" সঙ্গে যোগ হল "রয়্যাল" শব্দটি। "ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের" নাম হল "রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব"। এই ক্লাব শুধু ভারত নয়, বিশ্বের ঘোড় দৌড়ের ইতিহাসে এক সুপরিচিত নাম।
১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কোলকাতার রেসের মাঠে এলেন আরেক রানি। নাম এলিজাবেথ দ্বিতীয় আর সঙ্গে এলেন স্বামী প্রিন্স ফিলিপ। তারপর থেকে রানিকে সম্মান জানাতে শুরু হয় "ক্যুইন্স কাপ"। এটি শীতকালীন সব থেকে বেশি দূরত্বের ২৮০০ মিটারের দৌড়। আজও পুরনো প্রথা মেনে রানির কাছ থেকে সেই কাপ আসে। রেসের ফলাফলও রানির দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত ১লা জানুয়ারি শীতকালীন ডার্বি হয়। এছাড়া ক্যুইন্স কাপ, বর্ষাকালীন ডার্বি হয়ে থাকে।
এছাড়া রয়েছে "ভাইসরয় কাপ", "ভিক্টোরিয়া কাপ" এবং "এয়ারফোর্স কাপ"। নভেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস অবধি চলে শীতকালীন দৌড়। আর বর্ষায় মনসুন দৌড়। জুলাই থেকে অক্টোবর হল মনসুন রেসের সময়। বর্ষায় রেসের ট্র্যাক বিশেষভাবে করা হয়। যাতে বেশি বৃষ্টিতে কোনভাবে জল জমতে না পারে।
রেসে দৌড়নো ঘোড়াদের বিভিন্ন নাম রয়েছে। জকিদেরও নাম রয়েছে। কর্তৃপক্ষ ঘোড়া নির্বাচন করে দেন। জকিদের ঘোড়া নির্বাচনের ক্ষমতা নেই। খেলা হয় মাঠের হিসেবে যেমন ১১০০ মিটার, ১২০০ মিটার, ১৬০০ মিটার বা ১৮০০ মিটার। দিনে ৬ বার বাজি হয়। আধ ঘন্টা অন্তর বাজি শুরু হয়। সাধারণত শীতের সময় দুপুর ১২টা থেকে রেস শুরু হয়। অন্যসময় ২টো থেকেও রেস হয়।
সারা দেশে ৯টি রেস ট্র্যাক এবং ৬টি অথরিটি রয়েছে। তাঁরাই ঠিক করেন কোন ট্র্যাকে কবে খেলা হবে। সপ্তাহে যেকোনও দু'দিন আর সিজনের সময় মাসে ৬-৭ বার রেস হয়। ডার্বি বা কাপের খেলা শনিবার বা রবিবার করে হয়। বেট দশ টাকা থেকে শুরু হয়। জায়েন্ট স্ক্রিনে দেখে বেট করা যায়। একটি ছোট বই পাওয়া যায়। তাতে ঘোড়া আর জকির সমস্ত বিবরণ লেখা থাকে। ৩০ টাকা দিয়ে কিনলে সব কিছু ডিটেলসে জানা যায়।
৪০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে যে কেউ খেলা দেখতে পারেন। মোবাইল ব্যবহারে বিধি-নিষেধ রয়েছে। ক্লাবের সদস্যদের জন্য আলাদা বসার গ্যালারি। ভারতে ইন্ডিয়ান ব্রিড ছাড়া রেসে ঘোড়া নামানো যায় না। বিভিন্ন দেশ থেকে ঘোড়া আমদানি করে ঘোড়ার ব্রিড তৈরি করা হয়। কলকাতা ক্লাবের কাছে এখন ঘোড়া রয়েছে আপাতত ৪০০-৫০০।
রেসের আগে পিঠে লাগানো হয় নম্বর দেওয়া কাপড়। যাতে দূর থেকে সহজে চেনা যায়। ক্লাবের সদস্যদের গ্যালারির সামনে রয়েছে প্যাডক। সবুজ তৃণাচ্ছাদিত ওভাল আকৃতির মাঠকে বলা হয় প্যাডক। এখান থেকেই জকিরা ঘোড়ার পিঠে চেপে রেসের মাঠের দিকে এগিয়ে যায়। মাঠে নম্বর লাগানো খাঁচার ভিতরে ঘোড়াসহ জকিদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
একদল লোক জকিদের সঙ্গে থাকে। তাঁরাই এই কাজগুলো করে। স্টার্টারের সংকেত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় দৌড়। সঙ্গে সঙ্গে ছোটে অ্যাম্বুলেন্স। কেউ পরে গেলে যেন তৎক্ষণাৎ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়। ঘোড়া ছোটা শুরু করে। সেই সঙ্গে গ্যালারিতে বসে থাকা দর্শকদের উত্তেজনার পারদ চড়ছে থাকে। ফিনিশিং পয়েন্ট টাচ করার পর সেই উত্তেজনা বোমের মতো ফেটে যায়। অনেকের ঠোঁট চওড়া হয়ে যায়।
জকির ওজন ৪৮-৫০ এর মধ্যে হতে হয়। এর বেশি হবে না। বেশিরভাগ জকি অবাঙালি। এই খেলায় পুরুষের প্রাধান্য বেশি। কলকাতায় মেয়ে জকি নেই। চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোরে মেয়ে জকি রয়েছে। রূপা সিং ভারতের প্রথম মেয়ে জকি। অনেক খেলা সে জিতেছে। তবে মেয়ে হওয়ার জন্য নানারকমের সমস্যার সম্মুখীন প্রথমদিকে হতে হয়েছিল।
রাজাদের হাত ধরে শুরু হওয়া এই খেলা দেখতে এখন সাধারণ মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। খেলা শেষে কেউ হাসি মুখে বাড়ি ফেরে আবার কেউ বিষন্ন হয়ে। দৌড় কিন্তু থেমে থাকে না। জীবনকে বাজি রেখে শুরু হয় নতুন দৌড়। জীবনের দৌড় আর ঘোড়ার দৌড় কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ফিনিশিং পয়েন্ট ছোঁয়ার সময় দর্শকের গ্যালারি থেকে যে কলরব ভেসে ওঠে সে যেন না পাওয়া অনেক কিছুকে ক্ষণিকের দৌড়ের মধ্যে দিয়ে উদযাপন।