মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া। সেখানকার উকিল কুঞ্জলাল গাঙ্গুলির বাড়িতে ১৯২৯-এর ৪ আগস্ট জন্ম নিয়েছিলেন, ‘কিশোর কুমার গাঙ্গুলী’। মায়ের নাম, গৌরী দেবী। কিশোর ছিলেন বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান। ছোট থেকেই খুব বুদ্ধিমান আর অসম্ভব দুষ্টু। সিনেমায় আসার আগে অব্দি তাঁর ডাকনাম ছিল, 'খোকা'; আর ভালো নাম, 'আভাষ কুমার গাঙ্গুলি'।
ছোটবেলায় কিশোরের কণ্ঠে সুর তো ছিলই না, উপরন্তু, গলা এমন ফ্যাসফ্যাসে ছিল যে, অনেক কথা বোঝাই যেত না। তাঁর যখন বছর চার বয়স তখন একদিন রান্নাঘরে মায়ের কাছে যেতে গিয়ে মেঝেতে রাখা বঁটিতে পা পড়ে কচাত করে পায়ের আঙুল কেটে গেল, অমনি বেঁধে গেল মহা হুলুস্থূল কাণ্ড। তড়িঘড়ি তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল ডাক্তারখানায়। সেখানে ডাক্তারবাবু পায়ের কাটা অংশ সেলাই করে ওষুধ লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিলেন। কিন্তু, সেকালে পেনকিলারের রমরমা ছিল না। তাই পায়ে কাটার পর চার দিন ধরে নাগাড়ে এমন অসহ্য যন্ত্রণা হল যে, এই চারদিন ছোট্ট কিশোর সমানে চেঁচিয়ে কেঁদে গেলেন। কিছুতেই আর তাঁকে থামানো গেল না। সেই তারস্বর চেঁচানিতে বাড়িতে অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠা বাড়লেও, তাঁর গলা গেল খুলে, ফ্যাসফেসে ভাব গেল কেটে। গলা হয়ে গেল ঝরঝরে, দরাজ! আরে বাহ!--একেই তাহলে বলে, শাপে বর!
অনেকেই বলেন যে, কিশোরের প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা ছিল না। এটা মোটেই কাজের কথা নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে তিনি বিখ্যাত ওস্তাদ-পণ্ডিতের কাছে নাড়া বেঁধে গান শেখেননি। তাঁর সঙ্গীতজীবনের শিক্ষা ও মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ায় পাঁচটি মানুষের অবদান তিনি চিরদিন মনে রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে :
প্রথমজন হলেন, মা। ছেলেবেলায় মায়ের কণ্ঠে ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে তাঁর কানের সঙ্গে সুরের প্রথম পরিচয় ঘটে। এই পরিচয়ের স্মৃতি তিনি কোনদিন ভুলতে পারেননি।
দ্বিতীয়জন হলেন, দিদি সতী দেবী। দিদি ছিলেন সুকণ্ঠী সঙ্গীতজ্ঞা। তাঁর কাছেই কিশোরের প্রকৃত সঙ্গীত শিক্ষার হাতেখড়ি। কিশোরের সহজাত প্রতিভা এমনই বিস্ময়কর ছিল যে, তাঁকে যা দেখানো হত চটজলদি তিনি সেটা স্মৃতিতে বসিয়ে নিতে পারতেন। এজন্যই তিনি খুব দ্রুত সঙ্গীতের শিক্ষা আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন।
তৃতীয়জন হলেন, দাদামনি অশোক কুমার। দাদামনির কাছেও তিনি সঙ্গীতের পাঠ নিয়েছিলেন। কিশোর যখন সদ্য যুবক, তখনই দাদামনি হয়ে উঠেছিলেন মস্ত বড় গায়ক-নায়ক স্টার। দাদামনির ফিল্মের গান কিশোর তখন খুব করে গাইতেন। দাদামনি ছাড়াও আর একজনের গান তিনি খুব ভালোবাসতেন গাইতে, তিনি হলেন, আর এক বিখ্যাত গায়ক-নায়ক কে এল সায়গল। সাগয়ল জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়েছিলেন তখন। তাই, সে-সময় অধিকাংশ উঠতি গায়কই গাইতে শুরু করেছিলেন সায়গলের অনুকরণে, কিশোর কুমারও প্রথম প্রথম তাই করতেন। পরে নিজের পথ খুঁজে নিলেও চিরকালই তিনি সায়গলকে তাঁর গায়নপথের গুরু মানতেন। যৌবনে দাদামনির সাহায্য ও ইচ্ছেতেই ছায়াছবিতে কিশোরের প্রথম অভিনয় ও গান গাইতে আসা। অশোক কুমার অভিনীত ‘শিকারি’(১৯৪৬) ছবিতেই অভিনয়ে হাতেখড়ি হয় কিশোরের। এ-ছবিতে দাদামনির চাপাচাপিতে তিনি এক মালির চরিত্রে অভিনয় করেন।
চতুর্থজন হলেন, বম্বে টকিজের বাঁধাধরা মিউজিক ডিরেক্টার খেমচাঁদ প্রকাশ। দাদামনির ইচ্ছেতে কিশোর তখন বম্বে টকিজের মিউজিক গ্রুপে কোরাস গান করেন। সে-সময়ই একদিন তিনি চোখে পড়লেন খেমচাঁদের। কিশোরকে দিয়ে খেমচাঁদ প্লেব্যাক করালেন তাঁর সুরে ‘জিদ্দি’(১৯৪৮) ছবিতে— ‘মরনে কি দুয়ায়েঁ’ গানে। ক্রেডিটে গায়কের নাম দিতে গিয়ে 'আভাষ কুমার' হয়ে গেলেন, 'কিশোর কুমার'। কিন্তু, তখনও তিনি শুধুমাত্র সায়গলের অনুকারক, গায়কীতে নিজস্বতা তখনও তাঁর তৈরি হয়নি। তাই গায়ক নয়, দাদামনি চাইলেন ভাইকে নায়ক হিসেবে তুলে ধরতে—একেবারে নিজের মনের মতো করে।
নায়ক-পর্বটা বিচ্ছিরিভাবে কাটল কিশোরের। এই সময় তিনি একসঙ্গে বাইশখানা ছবিতে কাজ করলেন, তার মধ্যে ষোলখানা ছবিই ফ্লপ করল। একসঙ্গে এতগুলো ছবিতে কাজ করার সময় কোন ছবিতেই ঠিক মতো সময় দিতে পারেননি কিশোর, তাই প্রযোজকেরা এককাট্টা হয়ে ঠিক করলেন যে, আর কিশোরের সঙ্গে তাঁরা কাজ করবেন না। ফলে, তাঁর নায়কজীবন নিয়ে দেখা দিল চরম সংকট। আর ঠিক এই অবস্থাতেই তিনি ঘটিয়ে বসলেন আর এক কাণ্ড। ভালোবসতেন কলকাতার মেয়ে রুমা গুহঠাকুরতাকে, তাঁকে দুম করে বিয়ে করে ফেললেন। কিন্তু, রুমা ব্রাহ্ম বলে বাড়িতে এমন অশান্তি শুরু হল যে, বম্বে টকিজ থেকে কিশোরকে সটান বের করে দেওয়া হল। এতদিন কিশোর দাদামনির বাড়িতে থাকছিলেন, এবার কিশোর নিজেই সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। শুরু হল তাঁর অনিশ্চিত জীবন। ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই!
নায়ক হবার দরজা বন্ধ, তাই এইসময় রুমার পরামর্শে তিনি আবার গায়ক হওয়ার সাধনা শুরু করলেন। সেই মুহূর্তে তাঁকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন যে মানুষটি, তিনি হলেন শচীন দেব বর্মণ। ইনিই কিশোরের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া পঞ্চম মানুষ।
১৯৫০-এর এক সকালে শচীনদেবই প্রথম কিশোরকে পরামর্শ দিলেন সায়গলের অনুকরণ না-করে নিজের গায়কী খুঁজে নিতে। বুদ্ধিমান কিশোর অক্লান্ত সাধনায় এরপরই তাঁর সর্বজন পরিচিত নিজস্ব স্টাইল উদ্ভাবন করলেন। চরম হতাশাময় দিনগুলো অনেক যাতনার মধ্য দিয়ে পেরোবার প্রেরণা পেলেন শচীনদেবের কাছ থেকে। তাঁর সুরে ‘আরাধনা’-ছবিতে গান গেয়ে পুরস্কার পেলেন। পেলেন ব্যাপক জনপ্রিয়তা। আর পেলেন পায়ের নীচে মেরুদণ্ড সোজা করে মাথা উঁচু করে শক্ত পায়ে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত কঠিন মাটি।
জীবনের প্রথম ছবিতে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে কিশোর দেবানন্দের লিপে গান গেয়েছিলেন, তার পরেও ক্রমাগত গেয়েছেন। কিন্তু, শচীনদেবের জন্যই দেবানন্দ ছাড়াও তিনি রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র, অমিতাভ প্রমুখ নায়কের লিপে গাওয়ার সুযোগ পেলেন। কিশোরের সঙ্গীত-জীবনে শচীনদেবের অবদান অনেক। কিশোর তাই তাঁকে পিতার মতো সম্মান করতেন; উল্টোদিকে শচীনদেবও তাঁকে পুত্র পঞ্চমের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। কিশোর ও পঞ্চমের বন্ধুত্বও ইতিহাস। কিশোর ও পঞ্চম হয়ে উঠেছিলেন একে-অপরের পরিপূরক। কিশোরের সঙ্গীতজীবনে পঞ্চমের অবদানও কম নয়। শচীনদেব কিশোরকে যদি সঙ্গীতের রাজপথে রাজহস্তীতে সওয়ার করিয়ে থাকেন, তাহলে পঞ্চম অর্থাৎ রাহুলদেব তাঁকে বসিয়েছিলেন সঙ্গীতের রাজসিংহাসনে।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ১৯৮০ সালের পুজোয় বেসিক রেকর্ডে একটি গান গেয়েছিলেন কিশোর। গানের কথা লিখিয়েছিলেন বিখ্যাত গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে। আসলে গান নয়, এ-ছিল কিশোরের প্রানের কথা। সেই কথায় সুর দিয়েছিলেন কিশোরপুত্র, অমিত। গানটি হল—‘নাম আমার কিশোর কুমার গাঙ্গুলী’। এর শেষ ছত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বিদায়ের বিবাগী সুর। এখনো গানটা শুনলেই মনে হয় যেন কিশোরের কণ্ঠে এটাই তাঁর একমাত্র আত্মজীবনী, মৃত্যুর আগের শেষ এপিটাফ...
তথ্যঋণ : কিশোর কুমারের বিভিন্ন ভিডিও ও অডিও ইন্টারভিউ-আলেখ্য এবং কিশোর কুমার সম্পর্কে অশোক কুমার, রাহুল দেব বর্মণ এবং অমিত কুমারের ভিডিও ইন্টারভিউ।