জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে
অক্ষয় তৃতীয়া থেকেই জগন্নাথ ভূমে বেজে ওঠে ‘রথের বাদ্যি’। প্রভু জগন্নাথের ভক্তবাঞ্ছা পূরণের দিন যে এগিয়ে এল। এই শুভ দিনে সর্বজনে দর্শন দান করেন তিনি। গোটা বিশ্বের জগন্নাথপ্রেমী মানুষের অবশ্য গন্তব্য হয়ে ওঠে জগন্নাথ ধাম। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথি শুরু হচ্ছে ৭ জুলাই সকাল ৪:২৬ থেকে। ৮ জুলাই সকাল ৪:৫৯ এ শেষ হবে তিথি। চলতি বছর রথযাত্রা উৎসব আগামী ৭ জুলাই।
অক্ষয় তৃতীয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রভু জগন্নাথের রথ নির্মাণ। তৈরি হতে সময় লাগে প্রায় ২ মাস। প্রতি বসন্ত পঞ্চমীতে দশপল্লা মহিপুরের জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করা শুরু হয়। পুরীর রথের নির্মাণে ১,১০০ বড় কাঠের প্রয়োজন হয়। ১২ ধরনের কাঠ থেকে ৮ ফুটের বিশেষ ৮৬৫টি গুঁড়ি বেছে নেওয়া হয়।
মহানদীর তীর থেকে ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয় কাঠ। ওড়িশার দসাপাল্লা অঞ্চল থেকে বিশেষ কাঠমিস্ত্রির দল এসে রথ নির্মাণ করে। দসাপাল্লা আগে স্বাধীন রাজ্য ছিল। এখানকার কাঠের মিস্ত্রিরা অত্যন্ত দক্ষ।
পুরীতে জগন্নাথ স্বামীর রথযাত্রা উৎসবের শুরুর দিক থেকেই দসাপাল্লার কাঠমিস্ত্রিরাই রথ নির্মাণ করে আসছেন।
কোনওরকম আধুনিক সরঞ্জাম, কৌশল ছাড়াই নির্মাণ করা হয় এই রথ। রথ নির্মাণের নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য মাপগুলো হাতের মাপে নেওয়া হয়। পেরেক, নাট বল্টু, বা ধাতব কিছুরই ব্যবহার চলে না। প্রায় ১৪০০ কর্মী নিযুক্ত থাকেন রথ নির্মাণে। রথের কারিগররা সকলেই বংশপরম্পরায় প্রভু জগন্নাথের রথ নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত আছেন। একই সময়ে কারিগরদের ব্রহ্মচর্য পালন বাধ্যতামূলক।
জগন্নাথদেবের নন্দীঘোষ নামে রথটির উচ্চতা ৪৫.৬ ফুট। নির্মাণের জন্য ৭৪২ টুকরো কাঠের প্রয়োজন। বলরামের তালধ্বজ রথটি নির্মাণ করা হয় ৭৩১ টুকরো কাঠ দিয়ে। উচ্চতা ৪৫ ফুট। দেবী সুভদ্রার রথ দর্পদলনার উচ্চতা ৪৪.৬ ফুট। ৭১১টি কাঠের টুকরো লাগে রথ নির্মাণে।
রথ তিনটিতে বলরাম, সুভদ্রা এবং জগন্নাথের মূর্তি নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয়। ২০৮ কেজি সোনা দিয়ে সজ্জিত।
রথের ছাউনি তৈরি করতে ১,২০০ মিটার কাপড় লাগে।বলভদ্র, সুভদ্রা এবং প্রভু জগন্নাথের রথে ঘোড়াও আছে।আলাদা আলাদা নাম রয়েছে তাদের প্রত্যেকের। জগন্নাথদেবের রথের চারটি ঘোড়ার নাম শঙ্খ, বলহাকা, শ্বেতা, হরিদশ্ব। বলরামের চারটি ঘোড়ার নাম তীব্র, ঘোড়া, দীর্ঘশর্মা, স্বরনাভ। শুভদ্রার চারটি ঘোড়ার নাম রুচিকা, মোচিকা, জিতা ও অপরাজিত। জগন্নাথ, বলরাম ও শুভদ্রার রথের সারথীর নাম মাতালি, দাঁড়ুকা ও অর্জুন।
পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দির থেকে জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার তিনটি আজ্ঞামালা বহন করে আনেন তিন পান্ডা। জগন্নাথ দেবের অনুমতি নিয়ে শুরু হয় রথ তৈরির কাজ।
রথ যাত্রার সময় রথ চললে শব্দ হয়। এই শব্দেরো হিন্দু ধর্মে ব্যাখ্যা আছে। বেদে বলা হয় 'শব্দই ব্রহ্ম'। রথ চললে চাকার ঘর্ষণে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তাকে বলা হয় বেদ। অর্থাৎ এই শব্দ বেদের মতোই সত্য।
রথযাত্রায় রথের রশিতে টান দিতে, রশি স্পর্শ করতে আকুল হয় ভক্তরা। ভক্তদের বিশ্বাস, বাসুকি নাগই নাকি রথের রশি হিসেবে দারুদেবের কাছে নিজেকে উৎসর্গ তাই এই বিশেষ দিনটিতে রথের দড়ি ধরলে বাসুকিনাগের কৃপা লাভ হয়৷ যারা দড়ি ধরার সুযোগ পান না, তারা রথ চলার সময়, চাকার দাগ, ধূলো ছুঁয়ে পুণ্য লাভ করেন। তিনটি রথের তিনটি দাগ, গঙ্গা , যমুনা , সরস্বতী- এই তিন পবিত্র নদীর সমান। ভক্তরা গঙ্গা , যমুনা , সরস্বতীতে অবগাহনের ফল লাভ করেন৷