আগরপাড়ার গিরিবালা ঠাকুরবাড়ি ও রাধাগোবিন্দ আরাধনা

গঙ্গাতীরের ঐতিহাসিক জনপদ হল আগরপাড়া, সেখানেই রয়েছে রাধাগোবিন্দ জীউ মন্দির। বিটি রোড বা ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের উপর আগরপাড়ার মোল্লার হাটে নামতে হবে। সেখান থেকে হলধর বসু রোড ধরে গঙ্গার দিকে এগোলেই পথে পড়বে গিরিবালা ঠাকুরবাড়ি। ​চট করে দেখলে মনে হবে এ যেন দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের সঙ্গে এই মন্দিরের এতটাই মিল যে অনেকেই, এই মন্দিরকে ছোট দক্ষিণেশ্বরও বলেন। এই মন্দিরও গঙ্গার তীরে অবস্থিত। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রধান দেবী হলেন দক্ষিণকালী। এখানে রাধাগোবিন্দ বিরাজ করেন। এই মন্দিরটির সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আরেকটি যোগসূত্র রয়েছে। এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রানি রাসমণির নাতবউ। জানবাজারের গোপালকৃষ্ণ দাসের বিধবা স্ত্রী ছিলেন গিরিবালা দাসী। প্রয়াত স্বামী গোপালকৃষ্ণ দাস ও তিন পুত্রের স্মৃতিতে এই মন্দির গড়ে তোলেন তিনি। গিরিবালা দেবীর প্রতিষ্ঠা করা মন্দির বলে, মন্দিরটি গিরিবালা ঠাকুরবাড়ি নামে পরিচিত।

বাংলার ১৩১৮ সনের ১৮ জ্যৈষ্ঠ, মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্রাঙ্গণের মধ্যে ৭ ফুট উঁচু বেদীর উপর মন্দির অবস্থিত। মন্দিরের প্রবেশপথটি তিন খিলানযুক্ত। প্রবেশপথের সিঁড়ির দুপাশে পাথরের দুই মূর্তি রয়েছে। মন্দিরটি দক্ষিণমুখী। মন্দিরের পশ্চিম দিকে রয়েছে গিরিবালা ঘাট। এছাড়াও রয়েছে নহবতখানা এবং নাটমন্দির। তদানিন্তন সময়ে, মন্দির নির্মাণে খরচ হয়েছিল সাড়ে তিন লক্ষ টাকা। মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার গগনচন্দ্র বিশ্বাস এবং এস এম ঘোষ অ্যান্ড কোং। গিরিবালা ঠাকুরবাড়ি অর্থাৎ মূল মন্দির, নহবতখানা, ছ’টি শিবমন্দির ও সুদৃশ্য নাটমন্দির নিয়ে নির্মিত। গিরিবালা দেবীর উত্তরসূরিদের ইচ্ছায় ১৯৮৫ সালের ২৩ জানুয়ারি মহামণ্ডলেশ্বর শ্রী শ্রী শিবানন্দ গিরি মহারাজজির তত্ত্বাবধানে হরিদ্বারের ভোলানন্দ সন্ন্যাস আশ্রম এই মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এখন গিরিবালা ঠাকুরবাড়ি, ভোলাগিরি স্নেহনীড় নামেও পরিচিত।

মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে কষ্টিপাথরের কৃষ্ণ ও অষ্টধাতুর রাধা। সঙ্গে রয়েছেন গণেশ, নারায়ণ শিলা ও অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি। এই মন্দির তৈরির সময় রাধারানির মূর্তিটি চুরি হয়েছিল। স্বামী শিবানন্দ গিরি বৃন্দাবন থেকে অষ্টধাতুর রাধার মূর্তি এনেছিলেন, সেই মূর্তিটিই বর্তমানে পূজিত হচ্ছে। মন্দিরের সামনেই রয়েছে বাঁধানো প্রাঙ্গণ। তারপরেই নাটমন্দির, উত্তর দিকে মূল মন্দির। নাটমন্দিরটি লম্বায় প্রায় পঞ্চাশ ফুট এবং প্রায় চল্লিশ ফুট চওড়া, মেঝে শ্বেতপাথরে বাঁধানো। নাটমন্দিরের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে স্তম্ভ বোধিকা। এছাড়াও গঙ্গার তীরে ছয়টি শিব মন্দির। তাঁরা হলেন কামেশ্বর, রাজেশ্বর, গোপেশ্বর, তারকেশ্বর, ভুবনেশ্বর ও গিরিশ্বর। প্রতিটি মন্দিরের দরজায় খিলানের ওপর রাধাকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলার ছবি আঁকা রয়েছে। কামেশ্বর মন্দিরে রয়েছে যুগল মিলন, রাজেশ্বর মন্দিরে স্থান পেয়েছে মথুরানাথ, গোপেশ্বর মন্দিরে আঁকা রয়েছে গোষ্ঠলীলা, অনন্তশয্যা রয়েছে তারকেশ্বর মন্দিরে, ভুবনেশ্বর মন্দিরে রাই মিলন স্থান পেয়েছে এবং গিরিশ্বর মন্দিরে কালিয়াদমনের দৃশ্য আঁকা রয়েছে। শিবরাত্রির দিন সারারাত এখানকার শিবমন্দিরগুলোতে পুজো হয়। সেই সঙ্গে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা উৎসব, রাধাষ্টমী, জন্মাষ্টমী, দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা, ঝুলন, রাসযাত্রার ইত্যাদি নানা বিধ উৎসব পালিত হয়।

মূল মন্দিরের পূর্ব দিক বরাবর রয়েছে, অজস্র ঘর। শিব মন্দিরগুলির দিকে মুখ করা সারি সারি ঘরগুলির কোনওটা ভোগের ঘর, কোনওটা আবার ভাঁড়ার ঘর, ভক্ত ও সেবকদের জন্যেও রয়েছে কিছু ঘর। একদা মন্দিরের দেউড়ির বাইরে ছিল বিশাল কাছারি বাড়ি আজ যা ভগ্ন-পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। স্মৃতির অতলে সব তলিয়ে গেলেও, আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠাকুরবাড়ি। পূজিত হচ্ছেন রাধাগোবিন্দ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...