বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ পাহাড়। এই পাহাড় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কমপক্ষে বারো-তেরো শ’ ফুট উঁচু। এর চূড়াতেই রয়েছে চন্দ্রনাথ শিবের সুপ্রাচীন মন্দির, ‘চন্দ্রনাথ ধাম’। আর এই ধামই আসলে এক সুবিখ্যাত সতীপীঠ, যা একান্নপীঠের অন্যতম। কিংবদন্তি অনুসারে, এখানে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর ডান বাহু পতিত হয়েছিল। ‘পীঠনির্ণয়’ তন্ত্রগ্রন্থে সে-কথা স্পষ্টতই উল্লিখিত রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ
‘চট্টলে দক্ষবাহুর্মে ভৈরব চন্দ্রশেখরঃ
ব্যক্তরূপা ভগবতী ভবানী যত্রদেবতা।’
অর্থাৎ, চট্টল বা চট্টগ্রামে দেবী সতীর ডান বাহু পতিত হয়েছিল। এই পীঠস্থানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘ভবানী’ নামে পূজিতা হন। দেবীর ভৈরবের নাম, ‘চন্দ্রশেখর’। এই চন্দ্রশেখরই লোকমুখে চন্দ্রনাথ হয়েছেন; তাঁরই নামে নামাঙ্কিত হয়েছে তাঁর অধিষ্ঠানক্ষেত্র পাহাড়টিও।
শ্যামল-সবুজ বনানী পরিবেষ্টিত অসংখ্য ঝর্ণা, ঝোরা, গুহা ও পাহাড়িনদীর সমবায় হল চন্দ্রনাথ পাহাড়। পাহাড়ের অসংখ্য শিখর। প্রতিটি চূড়ায় চূড়ায় মন্দির, পৌরাণিক স্মৃতিধন্য কুণ্ড রয়েছে; তবে সবার ওপরে ভৈরব চন্দ্রশেখর ও দেবী ভবানীর মন্দির।
আসলে, এই পাহাড় দু’টি সতীপীঠের ধাত্রী। পাহাড়ের চড়াই কিছুটা অতিক্রম করার পর অনুচ্চ একটি চূড়া রয়েছে। সেখানেই সুদৃশ্য একটি মন্দিরে রয়েছেন স্বয়ম্ভূনাথ শিবলিঙ্গ। এই স্থানেই ছিল সুপ্রাচীন এক সতীপীঠ। এই পীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরই ভৈরব ছিলেন স্বয়ম্ভূনাথ। এ-সব জানা যায় ইতিহাসমাখা এক কিংবদন্তি থেকে। সেটি হলঃ
আজ থেকে কয়েকশো বছর আগের কথা। এক ধোপার গাভী পাহাড়ে চরতে এসে গোপনে দুধ দিয়ে যেত স্বয়ম্ভূনাথের লিঙ্গশিরে। দুধ কমতে থাকায় চুরির সন্দেহে ধোপা একদিন চুপি চুপি গাভীর পিছু ধাওয়া করে টের পায় স্বয়ম্ভূনাথের উপস্থিতি। সে মহাদেবের এই লিঙ্গমূর্তি ঝোপঝাড়ের আবরণ থেকে বের করে পুজো শুরু করে। দেবতার কৃপায় তার সমৃদ্ধি ঘটতে থাকে। দেবতার মাহাত্ম্যগাথা ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে ত্রিপুরায়। সেখানকার রাজা তখন ধনমাণিক্য। তিনি এই কৃপাময় দেবতাকে আপন রাজ্যে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা নিয়ে পীঠস্থানে লোকলস্কর নিয়ে হাজির হন। কিন্তু মহাদেবের এই স্বয়ম্ভূ অনন্ত লিঙ্গমূর্তিকে অনেক খুঁড়েও কিছুতেই তুলে আনতে পারলেন না। তখন রাজা খুব হতাশ হলেন। কেননা, দেবতাকে সঙ্গে করে বনিয়ে যেতে না-পারা মানে, দেবতার কৃপা থেকে বঞ্চিত হওয়া বলেই সেই মুহূর্তে রাজার মনে হল। হতাশ রাজাকে দেখে ঈশ্বরের মায়া হল। তখন মহাদেব নিযে যেতে না-পারলেও স্বপ্নে রাজাকে পীঠের অধিষ্ঠাত্রী ও সঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
তখন রাজা দেবীকে সঙ্গে করে এনে ত্রিপুরার উদয়পুরে ‘ত্রিপুরেশ্বরী’ নামে প্রতিষ্ঠিত করে মন্দির নির্মাণ করিয়ে পুজো শুরু করলেন। আমরা জানি, এই পীঠও বিখ্যাত সতীপীঠের মর্যাদায় বিশিষ্ট তীর্থ হয়ে উঠেছে। যাই হোক, সেই থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের অনুচ্চ শৃঙ্গের স্বয়ম্ভূনাথক্ষেত্রের সতীপীঠে এখন স্বয়ম্ভূনাথ একাই আছেন। একক অর্ঘ্যই গ্রহণ করেন।
স্বয়ম্ভূনাথের মন্দির ছাড়িয়ে সবুজের মাঝে পায়ে হাঁটা পথ উঠে গেছে ওপরে। কোথাও ইটের বাঁধানো সিঁড়ি, কোথাও পাথরের খাঁজ, কোথাও মাটি-কাঁকরের পথ উঠে গেছে চন্দ্রনাথের অত্যুচ্চ শিখরে। এই পথে পাহাড়ের নানান শৃঙ্গে, ঢালে একের পর এক মন্দির—ঊনকোটি শিবের মন্দির, পাতালপুরী, বিরূপাক্ষ মন্দির, সীতাদেবীর মন্দির, সীতাকুণ্ড, ব্যাসকুণ্ড প্রভৃতি রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রের আলাদা আলাদা পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। সে-সব ছাড়িয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টার চড়াই অতিক্রম করলে তবে পৌঁছনো যায় চন্দ্রনাথ পাহাড়ের শীর্ষে, তথা ‘চন্দ্রনাথ মন্দির’-এ।
স্বয়ম্ভূনাথের সুদৃশ্য মন্দিরটি দেবীকে লাভ করার পর স্বয়ং ধন্যমাণিক্য নির্মাণ করিয়ে দিয়েছিলেন; আয়োজন করেছিলেন তাঁর ধূমধামে নৈমিত্তিক পূজারও। শৃঙ্গে অবস্থিত চন্দ্রশেখর বা চন্দ্রনাথ শিবের মন্দিরটিও প্রথম নির্মাণের কৃতিত্ব তাঁর। যদিও সেই আদি মন্দির এখন অবশিষ্ট নেই। কেন নেই? সেই ইতিহাস আজ থেকে একশো বছর আগে এই তীর্থ ভ্রমণ করে ‘সচিত্র তীর্থ-ভ্রমণ-কাহিনী’ নামের বইতে গোষ্ঠবিহারী ধর লিখে গেছেন। সে-কথাই এখন উদ্ধৃতি সহযোগে তুলে ধরছিঃ
‘...এই মন্দিরটি কামাখ্যাদেবীর মন্দির যে পাহাড়ে অবস্থিত, তাহা অপেক্ষা দ্বিগুণ উচ্চে প্রতিষ্ঠিত। চন্দ্রনাথদেবের মন্দিরটী দেখিতে ঠিক স্বয়ম্ভূনাথের মন্দিরের ন্যায় ত্রিপ্রকোষ্ঠে বিভক্ত। পাণ্ডার নিকট অবগত হইলাম, সর্ব্বপ্রথমে এই চন্দ্রনাথ মন্দিরটী ত্রিপুরাধিপতি ধন্যমাণিক্য অকাতরে বহু অর্থ ব্যয়সহকারে নির্ম্মাণ করাইয়া প্রতিষ্ঠা করেন, এবং প্রভুর নৈমিত্তিক পূজা নির্ব্বাহের জন্য কতকগুলি ভূসম্পত্তিও প্রদান করেন, সেই আয়ের দ্বারা যথানিয়মে ভগবানের পূজা হইত। চন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গ পূর্ব্বে যে স্থানে ছিলেন, এক্ষণে সেই স্থানে নাই; কারণ একদা কালাপাহাড় সদলবলে এখানে উপস্থিত হইয়া উক্ত প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গসহ মন্দিরটী ধ্বংস করিয়া দেন; তৎপরে তাহারই অল্প ব্যবধানে বর্ত্তমান মন্দিরটী এই জেলার অন্তর্গত সারায়াতলী গ্রামের রামসুন্দর সেন নামে জনৈক পুণ্যাত্মা নিজ ব্যয়ে নির্ম্মাণ করাইয়া শিবলিঙ্গটী পুনঃপ্রতিষ্ঠাপূর্ব্বক আপন কীর্ত্তি স্থাপন করেন। এখান হইতে চতুর্দ্দিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য অতি মনোহর।’
গোষ্ঠবিহারীর বিবরণে দেবীমূর্তির উল্লেখ নেই। তবে ভক্তজন অনুমান করেন যে, মহাদেবের এই মন্দিরেই সতীপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভবানীরও মূর্তি অধিষ্ঠিত ছিল এবং তাও প্রাচীন লিঙ্গের সঙ্গে কালাপাহড়ের ধ্বংসলীলায় একত্রে বিনষ্ট হয়েছে। সেই মূর্তি কেমন ছিল, তা আর আজ জানার উপায় নেই। তন্ত্রগ্রন্থের স্তোত্রে ‘ভবানী’ নামে দেবী কালিকার বিবরণ পাওয়া যায়, সেই দেবী আসলে দেবী ‘কালিকা’। তিনি শবের উপর দণ্ডায়মানা, বসনহীনা, মুণ্ডমালাশোভিতা; অথচ মাতৃময়ী।
পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুসারে, এই চন্দ্রনাথপীঠ তথা চন্দ্রনাথতীর্থে রাম-লক্ষ্মণ ও সীতাদেবীর আগমনধন্য। এই তীর্থে সেই সময় ভার্গব নামে এক মুনি বাস করতেন। রাম-লক্ষ্মণ ও সীতা বনবাসকালে দক্ষিণ ভারতে যাওয়ার আগে এই তীর্থে আসেন এবং এসে ওঠেন ভার্গব মুনির আশ্রমে। সেই উপলক্ষে ভার্গব তাঁদের স্নানের জন্য তিনটি পৃথক পৃথক কুণ্ড নির্মাণ করেন। এখনও এখানে ‘রামকুণ্ড’, ‘লক্ষ্মণকুণ্ড’ ও ‘সীতাকুণ্ড’ নামের তিনটি কুণ্ডের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। এই কুণ্ডগুলো আসলে এককালের এক একটি উষ্ণ প্রস্রবণ, এখন একেবারেই মজে গিয়েছে। আরও একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এই তীর্থ ভগবান মহাদেব ও বিষ্ণুর বিচরণভূমি। দেবাদিদেব মহাদেব এখানে সর্বদা বিরাজ করেন।
চন্দ্রনাথ মন্দিরটি অনেক উঁচুতে অবস্থানের কারণে স্থানীয় মানুষ নিত্যপুজোর জন্য সেখানে তেমন যান না। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিদেশের বা দূরের ভক্ত, পর্যটক ও দর্শনার্থী সেখানে বেশ কষ্ট স্বীকার করে সেখানে যান, প্রাচীন লুপ্তপ্রায় এক ইতিহাস ও কিংবদন্তির সান্নিধ্যে এসে ধন্য হন। তারপর সেই মেঘছোঁয়া উচ্চতায় চারিদিকের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে খুঁজে নেন অপার অঝোর শান্তির ধারা। এই পীঠে সারা বছর তেমন ভিড় না-হলেও ফাল্গুন মাসের ক’দিন এখানে অসংখ্য ভক্তের সমাগম হয়। এই সময় শিবরাত্রি উপলক্ষে এখানে জমজমাট মেলা বসে। ব্রতের ধারায়, পূজায়, উদযাপনের মধ্য দিয়ে এই মিলনমেলা পূর্ণ হয়ে ওঠে।...