বণিককুলের ওপর গন্ধাসুরের খুব রাগ। সে একেবারে আকাট প্রতিজ্ঞা করেছে যে, সমগ্র বেনে সম্প্রদায়কে নিজের হাতে শেষ করবে। তাই ঘোরতর তপস্যায় শিবকে সন্তুষ্ট করে তাঁর বরে ভয়ানক বলীয়ান হয়ে উঠেছে।
গন্ধাসুরের অমন বেনে-বিদ্বেষী হয়ে ওঠার একটাই কারণ, তার বাপ, সুভুতি।
সুভুতি লোকটার চরিত্রের কোন ঠিকঠিকানা ছিল না। বউ থাকতেও সে একদিন বেনের মেয়ে সুরূপাকে হরণ করতে গিয়েছিল। কিন্তু, শেষরক্ষা হয়নি। বেনেদের হাতে ধরা তো পড়েইছিল, অশেষ মারধর খেয়ে লাঞ্ছনার একশেষ হয়েছিল। বলতে লজ্জা হয়, বাপের এই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই ব্যাটা তপস্যা করল, বল বাড়াল, বেনে-হত্যায় মন দিল। যাক গে, কী আর বলব, অসুরদের শিক্ষাদীক্ষাই অমন!
হালে পরিস্থিতি এমন যে, গন্ধাসুর বা তার সঙ্গোপাঙ্গরা যখন-তখন হানা দেয় বেনেপল্লিতে, যাকে সামনে পায় তাকেই হত্যা করে, বাড়িঘরদোর একেবারে তছনছ করে দিয়ে যায়।
সেদিন গন্ধাসুরের নির্দেশে সঙ্গোপাঙ্গরা হানা দিল সুবর্ণবট নামের এক বেচারা বেনের বাড়িতে। বাগে পেয়ে সুবর্ণকে তো হত্যা করলই, তার বউ চন্দ্রাবতীকেও হত্যার জন্য অনুসন্ধান করতে লাগল সুবর্ণর বংশ একেবারে ধ্বংস করবে বলে। কারণ, চন্দ্রাবতী পূর্ণগর্ভা।
বাড়িতে দুষ্ট অসুরদের হানা পড়তেই, সেই অতর্কিত বিপদে চন্দ্রাবতীর প্রথমেই মনে হয়েছিল পেটের সন্তানটিকে কেমন করে বাঁচাবে! আর অন্য কোন চিন্তা করার মতো তার মানসিক অবস্থাই ছিল না। ফলে, তক্ষুনি সে খিড়কি-দরজা দিয়ে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে পল্লি-শেষের অরণ্যে গিয়ে প্রবেশ করেছিল।
অরণ্যের মধ্যে একটি সুরক্ষিতস্থানের সন্ধানে চন্দ্রাবতী ছুটছিল। কিন্তু, এই অগাধ পরিশ্রমই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। তলপেটের অসহ্য যন্ত্রণায় অধীর হয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বুনো ঘাসের শয্যায় সে একসময় শুয়ে পড়ল। তারপর সেই অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে অচিরেই সে একটি অনিন্দ্যসুন্দর কন্যাসন্তানের জন্ম দিল। কিন্তু, প্রসবের পরিশ্রমে নিজের জীবন ধরে রাখতে পারল না, মরে গেল।
সেই অরণ্যেরই এক প্রান্তে ঋষি কশ্যপের তপোবন। সেখানেই তাঁর আশ্রম। তিনি ধ্যানযোগে দেবী মহামায়ার আদেশ পেলেন। জানলেন, দেবী বসুন্ধরা অরণ্যে জন্ম নিয়েছেন। জন্মলগ্নেই তিনি মাতৃহীনা পিতৃহীনা অভাগিনী। তাঁকে যেন কশ্যপ কন্যার মতো লালন-পালন করেন।
দেবীর আদেশ পেয়ে ঋষি বেরোলেন কন্যাসন্তানের সন্ধানে। তপোবন থেকে বেরোতেই হঠাৎ এক দিব্য সুগন্ধ তাঁকে চরম আকৃষ্ট করল। সেই সুগন্ধ যেন সমগ্র অরণ্যকে আমোদিত করে রেখেছে, তাঁকে টানছে উৎসের দিকে!
সেই টানেই হাঁটতে হাঁটতে তিনি পৌঁছে গেলেন কন্যাসন্তানটির কাছে। শিশুটি মৃত মায়ের পাশে খেলা করছে। তার নাড়িবন্ধন ছিন্ন হয়েছে। আহা, কী অপূর্ব, নিষ্পাপ সৃষ্টি! মুগ্ধ ঋষি তাকে কোলে তুলে নিলেন। তখন বুঝলেন, এই শিশু-অঙ্গই সুগন্ধের আকর!
চন্দ্রাবতীর সৎকার শেষে কন্যাকে কোলে করে কশ্যপ আশ্রমে নিয়ে এলেন। যেহেতু কন্যার দেহ থেকে বিচ্ছুরিত হয় অপূর্ব সুগন্ধ, তাই তার নাম রাখলেন, গন্ধবতী।
ঋষির বাৎসল্য ও শিক্ষাদীক্ষায় গন্ধবতী ধীরে ধীরে একদিন শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পা দিল। তিলোত্তমার মতো রূপে-লাবণ্যে দশদিক আলো করল।
তখন একদিন ঋষি তাকে জানালেন তার জন্মদাতা পিতা-মাতার মৃত্যুর নৃশংস কারণ। অসুরদের সেই নৃশংসতা জেনে গন্ধবতীর বুকেও প্রতিশোধের আগুন জ্বলল। ভীষণ যজ্ঞাগ্নি জ্বেলে সে এক কঠোর তপস্যায় প্রবৃত্ত হল।
ওদিকে গন্ধাসুরের অত্যাচারে বেনে সম্প্রদায় যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, নিহত হতে হতে নিঃশ্বেষ হতে বসেছে, 'ত্রাহি ত্রাহি' আর্তরবে দেবতাদের দোরে হত্যে দিয়ে নিত্যই চাইছে উদ্ধারের উপায়; ঠিক তখন সেই নারীলোভী পিতার নারীলোভী পুত্র গন্ধাসুরের কানে উঠল গন্ধবতীর অতুল্য অঙ্গসৌরভ ও অপরূপ সৌন্দর্যের কথা।
অমনি তার মন ঘুরে গেল বেনেদের দিক থেকে গন্ধবতীর দিকে। তাকে পাবার জন্য সে যেন একেবারে আকুল হয়ে গেল। সঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হল ঋষি কশ্যপের আশ্রমে।
হ্যাঁ, তুলে নিয়ে যাবে বলেই সে এসেছিল বটে, কিন্তু ধ্যানমগ্ন গন্ধবতীকে সাক্ষাৎ দেখে সে মোহিত হয়ে গেল। তাই প্রেমের কথায় বশীভূত করতে চাইল। কিন্তু না, তাতে গন্ধবতীর ধ্যানই ভাঙল না। প্রেমের জাল ব্যর্থ হতেই সে ভয় দেখাতে শুরু করল। উঁহু, তাতেও গন্ধবতীর ধ্যান ভাঙল না!
এবার গন্ধাসুর ধৈর্য হারাল। বার বার দু'বার ব্যর্থ হতেই তার মাথায় আগুন চড়ে গেল। সে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবার জন্য তেড়ে গিয়ে ধরল গন্ধবতীর চুলের মুঠি। কিন্তু, প্রাণপণ টেনেও সে গন্ধবতীকে একচুল নড়াতে পারল না, ধ্যানও ভাঙাতে পারল না, টেনে নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা!
অসুরকৃত অপমানে গন্ধবতীর ধ্যান না-ভাঙলেও, নারীর অপমানে অসম্ভব রুষ্ট হয়ে ধূমায়িত হয়ে উঠল যজ্ঞকুণ্ড। ঢেকে ফেলল সমস্ত চরাচর। সেই জগৎব্যাপী ধূম দেখে ভয় পেয়ে গেল অসুরের দল। গন্ধবতীর কেশ ছেড়ে গন্ধাসুর হতচকিত হয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
তখন যজ্ঞকুণ্ডের ধূম বিদীর্ণ করে আকাশব্যাপী এক জ্যোতির্ময়ী দেবীর আবির্ভাব হল। তাঁর চতুর্ভুজে সমুজ্জ্বল অস্ত্রমালা। তিনি সিংহবাহিনী।
এবার গন্ধবতীর ধ্যানভঙ্গ হল। সম্মুখে আবির্ভুতা দেবীকে সে প্রণাম করে বন্দনা করতেই দেবী তাকে অভয় দিয়ে রোষ-নয়নে তাকালেন গন্ধাসুরের দিকে। গন্ধাসুর প্রতি-আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল, সেও আকাশচুম্বী বিশাল দেহ ধারণ করে প্রচণ্ড হুঙ্কারে দেবীকে আক্রমণ করল। শুরু হল ঘোরতর যুদ্ধ।
সেই ঘোরতর যুদ্ধে ত্রিভুবন কেঁপে উঠল। দেবতারা ছুটে এলেন আকাশ-পথের ধারে, সেই ভয়াবহ যুদ্ধ দেখতে। অসুরেরা অজানিত ভয়ে লুকিয়ে পড়ল অন্তরালে। মানবেরা দেবতাদের শরণ নিল। বণিক সম্প্রদায় করজোড়ে প্রার্থনা করতে লাগল যাতে দেবী চিরতরে তাদের গন্ধাসুরের অত্যাচার থেকে উদ্ধার করেন, তার জন্য। আর দেবতারা পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা শুরু করলেন দেবীর বিজয় চেয়ে।
তুমুল যুদ্ধের শেষে অপরাজেয় দেবী চরম ক্রোধে তাঁর ভীষণ ত্রিশূল আমূল বিদ্ধ করলেন দুরাচারী অসুরের বুকে। সেই কালসদৃশ ত্রিশূলের আঘাতেই মৃত্যু হল গন্ধাসুরের। তার প্রাণহীন বিশাল দেহ পতিত হল পৃথিবীর বুকে। মাটির ভার লাঘব করতে দেবী অসম্ভব রোষে তাকে তুলে নিক্ষেপ করলেন সমুদ্রের বুকে।
নিদারুণ ক্রোধে দেবী তখনও পাগলপ্রায়, তাই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরসহ সমস্ত দেবতারা তক্ষুনি দেবীর সম্মুখে ছুটে এসে করজোড়ে দেবীর পূজা শুরু করলেন। অনেক স্তুতি করলেন। গন্ধাসুরকে বধ করে জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন বলে, এই নবদেবীকে তাঁরা দেবী 'গন্ধেশ্বরী' বলে সম্বোধন করলেন।
'গন্ধেশ্বরী' নাম পেয়ে এবং দেবতাদের আন্তরিক পূজা পেয়ে অবশেষে দেবী তুষ্ট হলেন, শান্ত হলেন।
তখন দেবীর ইচ্ছায় সমুদ্রে পতিত গন্ধাসুরের বিশাল দেহ পরিণত হল একটি বিশাল দ্বীপে। সেই দ্বীপে উদ্ভূত হল মশলা ও সুগন্ধদায়ী বৃক্ষ-লতা-বীরুৎমালা। দেবী সেই দ্বীপের নাম দিলেন, গন্ধদ্বীপ। বেনে-সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠীকে দেবী এই দ্বীপ থেকে গন্ধদ্রব্য আহরণ করে বাণিজ্যের অধিকার দিলেন, তাদের নাম দিলেন, 'গন্ধবণিক'।
দেবী গন্ধেশ্বরী যে-দিন গন্ধাসুরকে বধ করলেন সে-দিনটা ছিল বৈশাখী পূর্ণিমার দিন।
এ-দিন দেবী প্রথম আবির্ভুত হয়ে যেমন বণিক-সম্প্রদায়কে চিরদিনের জন্য গন্ধাসুরের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করলেন, ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করলেন, তেমনি 'গন্ধবণিক' সম্প্রদায়কে সৃষ্টি করে গন্ধ-বাণিজ্যের অধিকার দিলেন। তাই অচিরেই তিনি গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের পরম আরাধ্যা দেবী তো হয়ে উঠলেনই, সেই সঙ্গে বৈশাখী পূর্ণিমার দিন সমস্ত বেনেদের কাছেও মহাধুমধামে বাৎসরিক পুজো পেতে শুরু করলেন। এখন এই ঐতিহ্যই সমানে এগিয়ে চলেছে...
গল্পের উৎস : বেদব্যাস রচিত, 'মহানন্দীশ্বর পুরাণ'।