তমলুকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বর্গভীমার নৈবেদ্যে কেন প্রতিদিন শোল মাছের টক থাকে?

ইতিহাস প্রসিদ্ধ শহর তমলুক। এই শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা বর্গভীমা। দেবীস্থান একান্ন সতীপীঠের অন্যতম পীঠ।

পীঠ নির্ণয় তন্ত্র অনুযায়ী একান্ন পীঠের প্রথম পীঠ এটি। মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী পুরাণ এবং ব্রহ্ম পুরাণেও দেবী বর্গভীমার উল্লেখ রয়েছে।

সহস্রাধিক বছর ধরে পূর্ণশক্তিস্বরূপা হিসাবে আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী বর্গভীমার আরাধনা চলে আসছে এখানে। অনুমান করা হয়, পৌরাণিক তাম্রলিপ্ত জনপদ প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই দেবীর মন্দির এই স্থানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তিনি ভীমরূপা বা ভৈরব কপালী নামেও পরিচিত।

'তন্ত্রচূড়ামণি' অনুসারে দেবী হলেন কপালিনী। আবার 'শিবচরিত' অনুসারে দেবী হলেন ভীমরূপা। 'পীঠমালাতন্ত্র' অনুসারে কপালিনী ভীমরূপা।

মেদিনীপুর জেলা সদর তমলুক ইতিহাস প্রসিদ্ধ তাম্রলিপ্ত, যুগে যুগে বহু বদল ঘটেছে। একাধিক শাসক, বর্হিশত্রুর আক্রমণে অনেক বদল ঘটেছে এই ভূমির, কিন্তু এক থেকে গিয়েছে দেবী বর্গভীমা। জনশ্রুতি দেবী বর্গভীমার কাছে মন থেকে কিছু চাইলে মা নাকি ফেরান না।

মনে করা হয়, বর্গভীমা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাকাল একাদশ বা দ্বাদশ শতক। ওড়িশি স্থাপত্যের আদলে গড়া মন্দির। প্রায় ষাট ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট মন্দিরের দেওয়াল জোড়া টেরাকোটার কাজ। মন্দিরের ভিতরে কালো কষ্টিপাথরের দেবীমূর্তিতে উগ্ৰতারা রূপে বিরাজ করছেন দেবী বর্গভীমা। 

দেবী বর্গভীমা চতুর্ভুজা। তাঁর নীচে শায়িত রয়েছেন মহেশ্বর। দেবী উপরের ডানহাতে ধরে আছেন খড়্গ আর নীচেরটিতে ত্রিশূল। বাঁ হাতের একটিতে খর্পর এবং অপর হাতে মুণ্ড। বর্গভীমার দু'দিকে রয়েছে দশভূজা মহিষমর্দিনী এবং দ্বিভূজা মহিষমর্দিনী মূর্তি।

কথিত আছে, দেবী বর্গভীমার মন্দিরটি নির্মাণ করেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। কিন্তু, তমলুকের মানুষজন বিশ্বাস করেন, ময়ূরবংশীয় রাজারাই এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তবে বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদের মতে এই মন্দিরটি একটি বৌদ্ধসংঘ। পূর্ব ভারতের যখন হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ঘটেছিল সেইসময় বঙ্গদেশের শাক্তদের অর্থাৎ শক্তির উপাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছিল। সেই হিসাবে এই মন্দির সেনযুগে রাজা বল্লাল সেনের আমলে তৈরী হয়।

মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত আছে যে এক সওদাগর সিংহল যাওয়ার পথে তমলুক বন্দরে তার নৌকো থামিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি দেখেন এক ব্যক্তি একটি সোনার কলসী নিয়ে চলেছে। সওদাগর কৌতূহলী হয়ে ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলেন যে সে ঐ কলসী কোথায় পেয়েছে। উত্তরে সেই মানুষটি জানায়, কাছেই জঙ্গলের মধ্যে একটি কুয়ো রয়েছে যার জলে পিতলের ঘড়া ডোবালেই সেটা এক দেবীর কৃপায় সোনার হয়ে যায়। এই কথা শুনে সওদাগর বেশ কয়েকটি পিতলের কলসি কিনে তা ওই জলে ডুবিয়ে সোনা বানিয়ে তা অন্যত্র বিক্রি করে প্রচুর অর্থ লাভ করেছিলেন। ফেরার পথে তিনি কুয়োর পাশেই বর্গভীমা মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।

আবার অন্য একটি কিংবদন্তি বলছে তাম্রলিপ্তে ময়ূর বংশের দ্বিতীয় রাজা তাম্রধ্বজের আদেশে রাজ পরিবারে রোজ জ্যান্ত শোল মাছ দিতে আসতেন এক দরিদ্র ধীবর নারী। কিন্তু প্রচণ্ড শীত হোক বা তীব্র গ্রীষ্ম কিংবা প্রবল বর্ষাই হোক, সারাবছর প্রত্যেকদিন কীভাবে জ্যান্ত মাছের জোগান দেওয়া সম্ভবপর হয় ওই ধীবর পত্নীর পক্ষে - প্রশ্ন জাগে রাজার মনে। রাজার জেরার মুখে ধীবরপত্নী রাজাকে জানান, জঙ্গলের ভিতর একটি কুয়ো আছে যার জল ছিটিয়ে দিলেই মরা মাছ জ্যান্ত হয়ে যায়। সেইভাবে মরা মাছের প্রাণ ফিরিয়ে জীবিত করে সে রাজবাড়িতে নিয়ে আসত।

সেই জেলে বৌয়ের কথামতো ওই কুয়োর পাশে রাজা পেয়েছিলেন উগ্রতারারূপী দেবী বর্গভীমার কৃষ্ণবর্ণ মূর্তি। রাজা সেই স্থানেই মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। দেবী বর্গভীমা নামের সঙ্গে ধীবর সম্প্রদায়ের সম্পর্ক রয়েছে বলেও অনেক গবেষক মনে করেন। তাঁদের মত, ধীবর সম্প্রদায়ের আরাধ্যাদেবী 'ভীমা'ই হলেন মা 'বর্গভীমা'।

দেবী বর্গভীমার মন্দির সারা বছরই প্রত্যেকদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রত্যহ মা'কে পুজো করা হয়। রাতে অন্নভোগ নিবেদনের পর দেবীর নিদ্রার ব্যবস্থা করা হয়। সারাদিন দেবী বহু গহনা এবং শাড়ি পরিধান করে থাকেন।

তবে রাতের ভোগ নিবেদনের পর দেবীর সব অলঙ্কার খুলে ফেলা হয়। পরদিন ভোরে আবার সেগুলি দেবীকে পরিয়ে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ শক্তি পীঠের মতো এই পীঠস্থানেও দেবীর প্রসাদ নিরামিষ হয় না। দেবীর ভোগে এখানে রান্না করা শোল মাছ থাকবেই। এই দেবীর ভোগে শোলমাছ ছাড়াও পাঁচ রকমের মাছ, পাঁচ রকম ভাজা, পাঁচরকমের তরকারি দেওয়া হয়।

মা এখানে কখনও দুর্গা, কখনও কালী, কখনও জগদ্ধাত্রীরূপে পূজিতা হন। তবে, যেহেতু মন্দিরের দেবীমা কালিকারূপী, তাই দীপান্বিতা অমাবস্যায় মায়ের পুজো বিশেষ জাঁকজমক সহকারে করা হয়।

তমলুক শহরে আজও কোনও মণ্ডপে দুর্গাপূজার ঘটস্থাপনের আগে দেবী বর্গভীমার মন্দিরে পুজো দেওয়া হয়। এটিই এখানকার প্রচলিত প্রথা।

বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...