দেবাদিদেব মহাদেবের কাহিনী জানতে গেলে তাকে শুরু থেকে জানতে হবে। আজ বলব, ব্রহ্মাণ্ড ও ঋষিদের উৎপত্তি এবং সতী পার্বতী কথা। শিব পুরাণে এই কথা বিশদে আলোচিত হয়েছে। শিব পুরাণের জ্ঞান সংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ে প্রজাপতি দক্ষের জন্ম, তাঁর কন্যাদের জন্ম, দেবী সতীর মহাদেবের প্রতি অনুরাগের সৃষ্টি হওয়া, দক্ষযজ্ঞ ও সতীর দেহত্যাগের বিষয়ে উল্লেখ আছে। সেই আধ্যাত্মিক কাহিনীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে দেবাদিদেবের চরিত্র মাহাত্ম্য!
শিব পুরাণে বলা হয়েছে যে ব্রহ্মাও বিষ্ণুকে জগৎ সৃষ্টি ও পালন সম্পর্কে একাধিক উপদেশ দিয়ে মহাদেব অন্তর্হিত হলেন। এরপর ব্রহ্মদেব মহাদেবের আদেশ অনুযায়ী সৃষ্টি করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি জল ও জগত সৃষ্টি করলেন। সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ব্রহ্মা ধ্যান যোগে ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। ভগবান বিষ্ণু ব্রহ্মার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে আবির্ভূত হয়ে বললেন, ‘বর গ্রহণ করো’।
ব্রহ্মা তখন বললেন, ভগবান শিব আমাকে যে জগতের কথা বলেছেন সেই জগৎকে আমি জড় স্বরূপ দেখছি আপনি তার মধ্যে চৈতন্যের সঞ্চার করুন। জগৎ প্রথমে জড় অবস্থায় ছিল এরপর ভগবান বিষ্ণুর সংস্পর্শে তা সচেতন হয়ে ওঠে, অচেতন জগতের প্রাণ স্বরূপ হয়ে তিনি জগতের চেতনার বিস্তার করেন।
এরপর ব্রহ্মা বহু মানস পুত্র সৃষ্টি করেন। কিন্তু সেই সকল মানস পুত্ররা ছিলেন সংসার বিরাগী। তখন ব্রহ্মা সৃষ্টিকার্যর জন্য নারদ, ভৃগু,কর্দম,মরীচি,অঙ্গিরা,অত্রী,পুলহ,পুলস্ত,বশিষ্ঠ- ঋষিদের সৃষ্টি করলেন। তাঁদের মধ্যে নারদ ও পুলস্ত সংসার বিরাগী ও প্রজা সৃষ্টির ঘোর বিরোধী হলেও অন্যান্য ঋষিরা সংসারী ছিলেন। তখন ব্রহ্মা দ্রুত প্রজাসৃষ্টি ও প্রজাবৃদ্ধির জন্য প্রজাপতি দক্ষকে সৃষ্টি করলেন। ঋষি মরীচি থেকে মুনিবর কশ্যপের সৃষ্টি হল।
শিব পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, এই দক্ষ ও কশ্যপই সন্তান সৃষ্টি করে জগৎ পূর্ণ করে তোলেন। প্রজাপতি দক্ষের ষাটটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে তেরটি কন্যাকে দক্ষ কশ্যপকে সম্প্রদান করেন। সেই সব কন্যারা দেব, দৈত্য, দানব, নর, সর্প, পশু, পক্ষী, পর্বত, লতা প্রসব করে জগৎ পূর্ণ করে তোলেন। এইভাবে পাতাল থেকে ঊর্ধ্বে সত্যলোক পর্যন্ত সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড কোন না কোন সৃষ্ট জীবে বা বস্তুতে পূর্ণ হল। কোনও শূন্যস্থান রইল না। দক্ষ পরে তাঁর সতী নামে কন্যাকে রুদ্র বা মহাদেবের হাতে অর্পণ করেন।
দক্ষ প্রথম থেকেই মহাদেবকে অনার্য দেবতা বলে অসম্মান অবজ্ঞা করতেন, শুধু তাই নয় তাকে দেবতা হিসেবে তিনি কোন মান্যতায় দিতেন না। অন্যদিকে দক্ষ কন্যা সতী জন্ম থেকেই মহাদেবের পরম ভক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে যৌবনে তিনি মহাদেবের তপস্যা করে মহাদেব কে স্বামী হিসেবে লাভ করেন। এই বিয়েতে দক্ষ একেবারেই রাজি ছিলেন না, সতী পিতার অমতেই স্বামী নির্বাচন করেছিলেন। দক্ষ কিন্তু তখনও শিবকে সহ্য করতে পারতেন না। এরপর সতী বিয়ের পর কৈলাসে মহাদেবের কাছে চলে যান। কিছু সময় পরে তিনি জানতে পারেন যে তার পিতা দক্ষ এক বিরাট যজ্ঞের অনুষ্ঠান করছেন, কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে তিনি সকল দেবতাদের আমন্ত্রণ করলেও তার স্বামী শিবকে কোনরকম আমন্ত্রণ জানাননি। অন্যদিকে দেবাদিদেব মহাদেবকে বাদ দিয়ে কোন যজ্ঞ করলে তা নিষ্ফল হবে এই তত্ত্ব জানায় পিতার যজ্ঞ যাতে নিষ্ফল না হয়, পিতাকে বোঝাতে এবং দেবাদিদেবের যোগ্য ভাগ নিশ্চিত করতে, বিনা আমন্ত্রণে মহাদেবের অনুমতি না নিয়ে সতী দক্ষ যজ্ঞে উপস্থিত হন।
দেবাদিদেবকে বিয়ে করায় দক্ষ নিজের কন্যা সতীর ওপরেও অত্যন্ত রেগে ছিলেন। তাই বিনা আমন্ত্রণে সতীর আসায় তিনি আরও রেগে যান এবং সকল দেবতাদের সামনে মহাদেবের নামে নিন্দা করতে শুরু করেন।
পতিপরায়ণা সতী পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে জ্বলন্ত যজ্ঞাগ্নিতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণত্যাগ করেন। এদিকে শিব এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না। সতীকে তার পিতা দক্ষ তাঁর যজ্ঞে আহ্বান না করলেও সতী সেখানে যান। পরে দক্ষ শিবের নিন্দা করায় পতিব্রতা সতী যজ্ঞাগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দেন।
এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে এক ভয়ঙ্কর ক্রোধানলে প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠেন শিব। শিব তখন বীরভদ্র , রুদ্র প্রভৃতি তাঁর অনুচরদের নিয়ে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হন। বীরভদ্র সঙ্গে সঙ্গে দক্ষের শিরশ্ছেদন করেন। শিবের ভয়ঙ্কর মূর্তি দর্শনে ভয়ে পালাতে থাকেন দেবতা ও মুনি- ঋষিরা।
তখন ব্রহ্মার নির্দেশে প্রজাপতি দক্ষের গলদেশে ছাগমুণ্ড সংযোজিত করে তাঁকে পুনর্জীবন দান করা হয়। এদিকে শিব তাঁর প্রিয়পত্নী সতীর মৃতদেহটি কাঁধের উপর তুলে নেন। তারপর একটি হাত দিয়ে সতীর দেহটিকে ধরে অন্য হাতে ত্রিশূল নিয়ে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন। রুদ্রমূর্তি মহাদেবের পদভারে সমগ্র পৃথিবী কম্পিত হতে থাকে প্রবলভাবে। পাহাড়-পর্বত বিদীর্ণ হতে থাকে। উত্তাল হয়ে ওঠে সমুদ্র জলরাশি। সমতলভূমি ফাঁক হয়ে গিয়ে বড় বড় ফাটল ও গহ্বরের সৃষ্টি হয়।
এইভাবে অকালে প্রলয়কাল নেমে আসায় সৃষ্টি রসাতলে যেতে বসেছে দেখে বিচলিত হয়ে ওঠেন ব্রহ্মা । তিনি তখন বিষ্ণুর কাছে ছুটে গিয়ে শিবকে শান্ত করার জন্য অনুরোধ করেন বিষ্ণুকে। ভগবান বিষ্ণু তখন দেবাদিদেব মহাদেবকে শান্ত করার একটি উপায় বার করলেন। তিনি ব্রহ্মাকে বললেন, “শিবের প্রেমময়ী স্ত্রী সতীর মৃতদেহ যতক্ষণ শিবের কাঁধের উপর থাকবে ততক্ষণ শিবের তাণ্ডবলীলা বন্ধ হবে না, তাঁর রুদ্রমূর্তি শান্ত হবে না। আর তা না হলে আমার সমস্ত সৃষ্টি রসাতলে যাবে।
ব্রহ্মার কথা শুনে চক্র নিক্ষেপ করে সতীর মৃতদেহটিকে খণ্ড খণ্ড করতে লাগলেন বিষ্ণু। সতীর সেই দেহখণ্ডগুলি ভারতের নানা স্থানে শিবের গমনপথে পড়ে। পরে সেগুলি এক-একটি পীঠস্থান বা তীর্থে পরিণত হয়। দেবাদিদেব মহাদেবের এই কাহিনী যে শুনবে সে বুঝবে স্ত্রীকে যোগ্য সম্মান দেওয়া, স্ত্রীকে ভালোবাসা এবং স্ত্রীর অসম্মানে তৎক্ষণাৎ তার প্রতিবাদ করা আদর্শ স্বামীর লক্ষণ। তা যদি না হতো তাহলে স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব স্ত্রীর দেহত্যাগে স্ত্রীর সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের প্রতিকার করতে দক্ষের মুখে ছাগ মুন্ড বসাতেন না আর নিজের সৃষ্টি করা জগৎ নিজেই তোলপাড় করে তান্ডব সৃষ্টি করতেন না!
আসলে ভগবান এই লীলার মধ্য দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন যে নারী সব সময় সম্মানের অধিকারী, বিনা কারণে নারীকে যে অসম্মান করে তাকে সব সময় শাস্তি পেতে হয়। মহাভারতেও দ্রৌপদীর চোখ থেকে জল ঝরিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কৌরবরা! নারীর মূল্য, স্ত্রীর মূল্য দানকারী দেবাদিদেব মহাদেবের রুদ্রমূর্তি প্রমাণ করে পতিপরায়ণা স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করাই স্বামীর কর্তব্য।
উল্লেখ্য দেবী সতী দেহত্যাগ করে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন পার্বতী রূপে এবং দেবাদিদেব মহাদেবকে তপস্যা করে পুনরায় প্রাপ্ত হয়েছিলেন, কিন্তু সে এক অন্য কাহিনি।