কেন পালন করা হয় মন্থন ষষ্ঠী?

ভাদ্রমাসের শুক্লা পক্ষের ষষ্ঠীতে গ্রাম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয় চাপড়া ষষ্ঠী ব্রত। সন্তান কামনায় এবং সন্তানসন্ততিরা যাতে সুস্থ ও ভাল থাকে তার জন্য বিবাহিতা নারীরা এই ব্রত পালন করে থাকেন।

বাংলা বছরের প্রায় সব মাসেই ষষ্ঠীদেবীর পুজো হয়ে থাকে। নানা রকম নামে তিনি পূজিতা। ভাদ্র মাসে চাপড়াষষ্ঠী বা মন্থন ষষ্ঠীর পুজো হয়। তবে মূলত প্রকৃতি ফলবতী হওয়ার কামনায় উদযাপন।

মন্থন ষষ্ঠীর আগের দিন একটি প্রথা আছে। একটি পাত্রে পাঁচ রকম শস্য- মটর, মুগ, অড়হর, কলাই, ছোলা ভিজিয়ে রাখা হয়। পরদিন ষষ্ঠী পুজোয় এই উপাচারগুলির কিছু অংশ নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। বাকি অংশ সর্ষে এবং মাটির সঙ্গে মেখে নতুন সরাতে রাখা হয়। দ্বাদশী পর্যন্ত মেয়েরা স্নান করে প্রতিদিন এই সরাতে অল্প অল্প জল দিয়ে থাকে। চার-পাঁচদিন পর যখন চারা ওঠে তখন জানা যায় সে বছর কেমন শস্য হবে। তখন মেয়েরা শস্য উৎসবের আয়োজন করে। 

চাপড়া ষষ্ঠী নিয়ে ব্রতকথার কাহিনিও প্রচলিত আছে। সেই কাহিনি নিম্নরূপ-  

 এক দেশে এক সওদাগর আর তার স্ত্রী তাদের তিন ছেলে বউ আর নাতিনাতনি নিয়ে বাস করত। সওদাগর বেশ ধনী ছিল। সব নাতিনাতনির মধ্যে ছোট বউয়ের ছেলেকে পরিবারের সবাই একটু বেশি ভালোবাসতো। একবার ভাদ্র মাসে ষষ্ঠী পুজোর সময় সওদাগরের স্ত্রী তাকে বলল, বউ-ছেলেপুলে নিয়ে অন্যদের পুকুরে ষষ্ঠী পুজো দিতে যেতে ভালো লাগেনা। যদি নিজেদের পুকুর থাকত ,কত ভালো হতো, এই কথা শুনে সওদাগর তার বাড়ির সামনে মজুর ডাকিয়ে বড় করে পুকুর কাটালো ও তার চারদিকে ঘাট বাঁধিয়ে নানা গাছ লাগিয়ে দিল। কিন্তু পুকুরে একফোঁটাও জল উঠল না। তাই দেখে সওদাগর আর তার পরিবার খুব দুঃখ পেল। আর পাড়ার লোকে কানাকানি শুরু করল। তারা আলোচনা করতে লাগল, “ওরা নিশ্চয়ই পাপী লোক, তাই ওদের পুকুরে জল উঠছে না। এসব কথা শুনে সওদাগর মনে মনে মা ষষ্ঠীকে ডাকতে থাকল।”

একরাতে সওদাগর স্বপ্ন দেখল মা ষষ্ঠী তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলছেন, কাল তো ষষ্ঠী, তুই তোর যে ছোট নাতিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস তাকে কেটে, সেই রক্ত যদি পুকুরে ছড়িয়ে দিতে পারিস তাহলে এই পুকুরে জল উঠবে।

ঘুম ভেঙ্গে সওদাগর হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। গিন্নিকে সব কথা জানাল, সকালে নিজের কাজ সেরে ছোট নাতিকে কাছে নিয়ে এল তাকে খুব আদর করে নিজের মনকে শক্ত করে ভাবল মা ষষ্ঠীর আদেশ পালন করতেই হবে। মায়ের দয়া হলে আবার মা নাতিকে ফিরিয়ে দেবেন এই আশায়, ভরসায় সে তার ছোট নাতিকে কেটে তার রক্ত পুকুরে দিয়ে দিল।

দেখতে দেখতে তখনই পুকুরের চারদিকে ভরে গেল জলে। সওদাগর তাড়াতাড়ি গিন্নিকে ডেকে আনল। তারপর পুরোহিত ডেকে পুকুর প্রতিষ্ঠিত করল। সেদিন ছিল ষষ্ঠী। তারা সবাই মিলে ঘাটে ষষ্ঠী পুজো করতে বসল। পুজোর শেষে ব্রত কথা শুনে সবাই তার ছেলের নাম করে পিটুলির পুতুল ও চাপড়া জলে ভাসাল, আর নিজের নিজের ছেলের নাম করে বলল- চাপড়া গেল ভেসে অমুক এল হেসে।

অমনি ছোট বউয়ের ছেলে তার আঁচলে টান দিতেই জলের ভিতর থেকে উঠে এল তার ছেলে। তারপর ছোট বউ তার ছেলের গা মুছিয়ে কোলে বসিয়ে খুব আদর করল কিন্তু কীভাবে সে জলের ভেতর থেকে উঠে এল জিজ্ঞেস করলে ছেলে কিছু বলল না। এরপর সওদাগর তার স্বপ্নের কথা সবাইকে জানাল।

ছোট বউ ভয়ে মূর্ছা গেল। পরে চেতনা ফিরলে সে মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করে খুব কাঁদল। তারপর তিন বউ মিলে মা ষষ্ঠীর খুব নাম জপ করল। তাদের ছেলে কেটে তার রক্তে পুকুরের জল ওঠা আবার মা ষষ্ঠীর কৃপায় ছেলেকে ফিরে পাবার গল্প চারিদিকে প্রচার হতে লাগল। সওদাগর আর তার পরিবার আনন্দের সঙ্গে চাপড়া ষষ্ঠী ব্রত কথা ,তার মহিমা চারিদিকে প্রচার করতে লাগল।

সেই থেকে এই চাপড়া ষষ্ঠীর ব্রতের মাহাত্ম্য কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...