যুদ্ধ। শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে যন্ত্রণা, দুঃখ, হতাশা। প্রত্যেকটা যুদ্ধই হয়ত অনেকটা অন্ধকার নিয়ে আসে।
কিন্তু আড়ালে লুকিয়ে থাকে কোনও না কোনও আলোর খোঁজ। যে আলোয় থাকে জীবনের বার্তা। যে আলো সমস্ত বিষাদ ভুলিয়ে দেয়। আশার রেখা এঁকে দেয় মানুষের চোখে। তেমনি কিছু গল্প ভাগ করে নেব। আজ প্রথম পর্ব।
সময়টা ছিল ১৯১৮ সালের ৩ অক্টোবর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে গুলি চালানো শুরু করল জার্মান সৈন্যরা।
কী আছে আকাশে?
গুলির আঘাতে আহত হয়ে মাটিতে পড়ল একটা পাখি। পায়রা। সৈন্যরা ভেবেছিলো গুলির আঘাতে নিশ্চয়ই এই খুদে প্রাণ মারা গিয়েছে। বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিল তারা।
কিন্তু যার ডানায় জীবনের সংকেত লুকিয়ে আছে, সে কি এত সহজে তার কর্তব্যকে বিদায় জানাতে পারে!
আহত অবস্থাতেই আবার উড়তে শুরু করেছিল পায়রাটি।
জার্মান সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার উড়ে গিয়েছিল মার্কিন সৈন্যদের হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত।
ডানায় বাঁধা ছিল একটা ছোট্ট চিরকুট। তাতে লেখা মার্কিন সৈন্যদের বার্তা।
"আমরা ২৭৬/১ নম্বর রোডের খুব কাছের একটা জায়গায় আটকে পড়েছি। মিত্রবাহিনী না বুঝেই আমাদের লক্ষ্য করে অনবরত গুলি চালাচ্ছে। ভগবানের দোহাই, এটা বন্ধ করো।''
১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসের শুরু থেকেই নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিল আমেরিকার সৈন্যবাহিনী। সেই সময়ে প্রযুক্তিও এতটা উন্নত হয়নি।
তাই চিঠিপত্রই ছিল যোগাযোগের মাধ্যম। আর যুদ্ধক্ষেত্রে গোপনে বিভিন্ন বার্তা আদান প্রদান করা হতো চিঠিপত্রের মাধ্যমে। কিন্তু সেই সমস্ত গোপন ডেরায় মানুষের পক্ষে পৌঁছোনো প্রায় অসম্ভব
তাই বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত পায়রাদের। প্রাচীনকাল থেকেই পায়রা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। বিভিন্ন মিশনে অংশগ্রহণ করত পায়রা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও অনেক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পায়রা যোগ দিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় পাঁচশো জন মার্কিন সৈন্য শত্রুপক্ষের সীমানায় আটকে পড়েছিল।
তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পায়রাদের মাধ্যমে মার্কিন হেডকোয়ার্টারে তাদের অসুবিধার বার্তা পৌঁছোনোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দুজন পায়রা আগেই জার্মান সৈন্যদের গুলিতে প্রাণ হারায়।
তারপর এই তৃতীয় এবং শেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পায়রা ছিল তাদের সঙ্গী। নাম ছিল "চিয়ার এমি"। জার্মান সৈন্যদের গুলিতে আহত হলেও তার ডানায় বাঁধা চিরকুটটি পৌঁছে দিয়েছিল মার্কিন হেডকোয়ার্টারে। প্রায় একশ চুরানব্বই জন সৈন্যের প্রাণ বাঁচিয়েছিল।
নিজে আহত হয়েছিল "চিয়ার এমি"। এক চোখ দিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। অন্য চোখের সাহায্যেই পাড়ি দিয়েছিল বাকি পথটুকু। তবে বুকে গুলি লাগায় আর অন্য কোন মিশনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।
তার একটি পাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে সামরিক ডাক্তারেরা পায়রাটির জন্য একটি বিকল্প কাঠের পা তৈরি করে দিয়েছিল। কোন যুদ্ধের মিশনে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও, অন্য নানা ক্ষেত্রে নিজের কাঠের পা নিয়ে ঘুরে বেড়াতো "চিয়ার এমি"।
তার বিশেষ কৃতিত্বের জন্য ফরাসিরা তাকে "ক্রয়িক্স ডি গোয়েরি" অর্থাৎ বিশেষ সাহসিকতার পদক দিয়ে সম্মানিত করে।
জীবন নকশী কাঁথার মত। নানা অনুভূতি দিয়ে সেলাই করা। 'চিয়ার এমি'র সাহসিকতা আজও জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করে মানুষকে। তাই সৈন্যবাহিনীর প্রশিক্ষণের সময় তার গল্প শোনানো হয় এখনও।