বাংলার বিশ্বশ্রী বাঙালির পকেট হারকিউলিস মনোহর আইচ

ফেলুদা বলেছিলেন, কাশীতে এসে বিশ্বনাথের মন্দির তো সব্বাই দেখেন, বিশ্বশ্রীর মন্দির আর ক'জন দেখতে পান। ওটা গপ্পো, কিন্তু আসল বিশ্বশ্রীর মন্দির ছিল কলকাতাতেই। ১০৪ বছর বয়সে তিনি চলে গিয়েছেন। আদপে বাঙালি ফাটিয়ে সিনেমা বানিয়েছে, জমিয়ে কলম চালিয়েছে আর সেই সঙ্গে কসরতও করেছে। মানুষটার নাম মনোহর আইচ।

মুসুরির ডাল আর পুঁইশাকের চচ্চড়ি ছিল ষোলো আনা বাঙালিবাবু মনোহর আইচের প্রিয়। এদেশে বডি বিল্ডিংকে সর্বোচ্চ শৃঙ্গে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনিই। তাঁর হাত ধরেই ভারতে পাওয়ার বডি বিল্ডিংয়ের জন্ম। বডি বিল্ডিং মানে শুধু পেশি ফোলানো নয়। বডি বিল্ডিং মানে শক্তি প্রদর্শনও, তা তিনিই প্রমাণ করে গিয়েছেন। 

ভোজন রসিক ছিলেন, মুসুরির ডাল আর পুঁইশাকের চচ্চড়ির পাশাপাশি মাছের মুড়ো আর কচুর লতিও ভালবাসতেন। শেষ জীবনে কফি, চা, বিস্কুট ছাড়া মাছের ঝোল আর ভাতই খেতেন। যদিও সব পেস্ট করা। পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানা ছিল তাঁর সম্বল। একদা বাংলায় থাকার জন্য ইংল্যান্ডে থাকার প্রস্তাব হেলায় প্রত্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। 

১৯১২ সালের ১৭ মার্চ অর্থাৎ আজকের দিনে অবিভক্ত বাংলার কুমিল্লার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম মনোহর আইচের। ছেলেবেলা থেকে কুস্তি, ভারত্তোলনের উপর তাঁর আগ্রহ ছিল। ছোটবেলাতেই ভর্তি হয়েছিলেন রূপলাল ব্যায়াম সমিতিতে। ঢাকায় থাকাকালীন ফিজিক অ্যান্ড ম্যাজিক নামে একটি প্রদর্শনীতে পিসি সরকারের সঙ্গে শারীরিক কৌশল প্রদর্শন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। শারীরিক সৌষ্ঠবই ছিল তাঁর নেশা। সৌষ্ঠবের জন্যই তত্‍‌কালীন ব্রিটিশ আধিকারিকদের প্রশংসার পাত্র ছিলেন তিনি। তবে দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে কখনও আপোস করেননি। এক ব্রিটিশ আধিকারিককে চড় মারার কারণে কারাবাস করেছেন। জেলেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁকে শরীরচর্চা করতে দেখে অবাক হয়ে যান ইংরেজরা। তাঁর জন্য বিশেষ খাবার-দাবারেরও ব্যবস্থা করে সাহেবের দল। ১৯৫০ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মিস্টার হারকিউলিস খেতাব জেতেন তিনি। উচ্চতায় তিনি ছিলেন মাত্র ৪ ফিট ১১ ইঞ্চি, সেই কারণে নাম হয়ে গিয়েছিল পকেট হারকিউলিস। পরের বছর মিস্টার ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান পান। ১৯৫২ সালে জিতেছিলেন বিশ্বশ্রীর সম্মান। ১৯৫৫ ও ৬০ সালে মিস্টার ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় তিনি যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। 

জেলের ব্যাপারটা খোলসা করে বলি, মনোহরের সাত বছরের জেল হয়েছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য। তিনি র‌য়্যাল এয়ারফোর্সে কাজ করেছেন। সে সময় নিয়ম ছিল রাতে ব্রিটিশ অফিসারদের ডিনারের পর বেঁচে যাওয়া খাবার সকালে ভারতীয় সৈনিকদের দেওয়া হত। প্রতিবাদ করেছিলেন মনোহর। সাত বছরের সাজা হয় তাঁর।

যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ায় চার বছরেই সাজা শেষ হয়ে যায়। লাহোর, পেশোয়ার হয়ে মনোহরের হাজতবাস শেষ হয় আলিপুর জেলে। এই চার বছরে বডি বিল্ডিংয়ের চর্চা চালিয়ে যান মনোহর। বডি বিল্ডিংয়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা এবং নিষ্ঠা দেখে জেলের আধিকারিকরাও জেলে তাঁর জন্য স্পেশ্যাল ডায়েট চালু করে দেন। জেল থেকে বেরোনোর এক বছরের মধ্যে স্বাধীন ভারতে প্রথম মিস্টার ইউনিভার্স হন মনোহর। তারপর আর পিছনে ফিরে দেখতে হয়নি তাঁকে।

তিন তিনটি এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রদর্শিত কসরতগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৩০০কি.মি. স্কোয়াট করা, মাংসপেশির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রদর্শন ও ১৫০০ পাতার বই ছিঁড়ে ফেলা। সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। বৃদ্ধ বয়সেও নিজের ব্যায়ামাগার, দ্য ফিজিকে একটানা ৯০ মিনিট ব্যায়াম অনুশীলন করতেন। ভারতীয় বডি বিল্ডিংয়ের রত্ন সত্যেন দাস, সত্য পাল, ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন সিনহা এবং হিতেশ চ্যাটার্জীরা মনোহর বাবুর ছাত্র। 

নিজের ৪ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে তিনি বাঙালিকে অনন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে গিয়েছেন। বাঙালির জীবন মাছে-ভাতে-দুধে আবর্তিত। মেধা বলতে কেবল বিদ্যেই বোঝে তারা! শরীরচর্চা বিমুখ; মনন আর মস্তিষ্কর চর্চাই জীবনের সার বলে মনে করছে যে বাঙালি, সেই বাঙালিকে শরীর এক মন্দির ভাবনায় ভাবাতে শুরু করেছিলেন, মনোহর আইচরা। রোগপীড়ায় কাতর বঙ্গ সন্তানদের সুস্বাস্থ্যের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন মনোহর আইচ।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...